হাবিব আল মাহমুদ:
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রাষ্ট্রের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে “আদিবাসী” শব্দের ব্যবহার এবং এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সার্বভৌমত্বের ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন ১৬৯-এর আওতায় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার ও স্বীকৃতির বিষয়টি জাতীয় স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আইএলও কনভেনশন ১৬৯: আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ১৯৮৯ সালে “আদিবাসী ও উপজাতীয় জনগণের অধিকার সম্পর্কিত কনভেনশন” (কনভেনশন ১৬৯) প্রণয়ন করে। এই কনভেনশন অনুযায়ী, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলি নিজস্ব অঞ্চল, সম্পদ, এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারে এবং এর উপর তাদের বিশেষ অধিকার রয়েছে। এর মানে, এই জনগোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ওপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ বা স্বায়ত্তশাসন দাবি করতে পারে, যা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি:
১. আলাদা রাজনৈতিক পরিচয়: আইএলও কনভেনশন ১৬৯ অনুসারে আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলি তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার পায়। যদি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীকে “আদিবাসী” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবে তারা আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বা আলাদা শাসনব্যবস্থার দাবি করতে পারে। এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক এবং সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।
২. আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ: “আদিবাসী” হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি (যেমন জাতিসংঘ) সেই জনগোষ্ঠীর অধিকারের রক্ষা করতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে বাইরের শক্তির প্রভাব বাড়তে পারে, যা দেশের স্বাধীন নীতি ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।
৩. আঞ্চলিক সংহতির ক্ষতি: পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে “আদিবাসী” হিসেবে স্বীকৃতি দিলে, তারা আলাদা জাতীয় পরিচয়ের দাবি করতে পারে। এর ফলে দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যা জাতীয় সংহতির জন্য একটি বড় হুমকি।
কেন “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহার সংবিধান পরিপন্থী?
বাংলাদেশের সংবিধানে “আদিবাসী” শব্দটি স্বীকৃত নয়, বরং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধান অনুসারে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান অধিকার ও সুযোগ পাবে, তবে কোনও গোষ্ঠীকে আলাদা আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে তাদের জন্য বিশেষ অধিকার এবং সুবিধা তৈরি হতে পারে, যা অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য তৈরি করতে পারে। এর ফলে, দেশের অভ্যন্তরে একটি ভিন্ন রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শ্রেণী তৈরি হতে পারে, যা রাষ্ট্রের জন্য একটি জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
“আদিবাসী” শব্দের ব্যবহার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ কারণ এটি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরে না, বরং তাদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকারের একটি নতুন স্তর তৈরি করতে পারে। আইএলও কনভেনশন ১৬৯-এর অধীনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর আঞ্চলিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে দেশের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা এবং জাতীয় সংহতি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই, এই ইস্যুতে সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়া এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অগ্রগণ্য।