শুধুমাত্র একটি সড়ক পাহাড়ের অর্থনীতিতে নিয়ে আসতে পারে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এই সড়কটির নাম বগাছড়ি-নানিয়ারচর-লংগদু সড়ক। সড়কটি ঘিরে থমকে আছে পাহাড়ের লাখো মানুষের স্বপ্ন আর যোগাযোগের নয়া দিগন্তের হাতছানি। এই সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে পাহাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনই নয়, বরং পর্যটন, কৃষি এবং শিক্ষা স্বাস্থ্যসহ উন্নয়ন কর্মকান্ডেও নতুন গতি আসবে বলে মনে করছে স্থানীয়রা।
বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদঘেরা পার্বত্য রাঙামাটির যোগাযোগ নির্ভরশীল পানিপথের উপর। জেলার পাঁচটি উপজেলার সাথেই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নদীপথ। এই সড়কটি নির্মাণ করা হলে জেলাসদরের সাথে লংগদু, বাঘাইছড়ি এবং বরকলের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ইতোপূর্বে সেনাবাহিনী ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যটালিয়ন এই সড়কটি নির্মাণ কাজ শুরু করলেও অজানা কারণে মাঝপথেই থেমে যায়। জানা গেছে সড়ক বিভাগ এই সড়কটি নির্মাণে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনাও জমা দিয়ে রেখেছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে বলে সূত্রটি দাবি করেছে।
সম্প্রতি সড়কটির এগারইল্যাছড়া এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এলাকার হাজারো মানুষ নিদারুন কষ্টে চলাফেরা করেন পাহাড়ি এই মেঠোপথ দিয়ে। স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, কৃষক, উপজেলা সদরে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষ পায়ে হেটেই চলেন এই পাহাড়ি পথে।
স্থানীয় গবাছড়ি এলাকার বাসিন্দা বিমল বিকাশ চাকমা জানান, সকালে গবাছড়ি থেকে পায়ে হেটে নানিয়ারচর বাজারে গিয়েছি। বাজার করে বাড়ি ফিরতে এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। কবে নাগাদ এই সড়কটি নির্মাণ করা হবে আমরা সেই স্বপ্নে প্রহর গুনছি।
ঝুড়ি মাথায় করে ঘরে ফেরার তাড়ায় থাকা এক পাহাড়ি নারীর সাথে কথা বলতে চাইলে তার চোখমুখ থেকে একরাশ হতাশা ঝরে পড়লো। তিনি জানালেন, রাস্তা নেই, গাড়িঘোড়া নেই; মাথায় ঝুড়ি নিয়ে বাজার থেকে ফেরা কি যে কষ্ট তা ভূক্তভোগী ছাড়া অন্যরা বুঝতে পারবে না।
স্থানীয় রুপন চাকমা জানান, কি নিদারুন কষ্টে এখানকার মানুষ দিনাতিপাত করে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি পণ্য পরিবহণে ভোগান্তির কারণে অনেক ফসল আমরা বিক্রি করতে পারি না, ক্ষেতেই পঁচে নষ্ট হয়ে যায়।
আনারসের রাজধানী ক্ষ্যাত নানিয়ারচর থেকে প্রতিবছর শতশত ট্রাক আনারস সরবরাহ করা হয় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। কৃষকরা না পায় পণ্যের সঠিক দাম আর না পায় পরিশ্রমের মূল্য। সারাদেশেই হানিকুইন জাতের এই আনারসের ব্যপক চাহিদা রয়েছে । সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে এখানে আনারসের চিপস, জ্যুস ও বিভিন্ন প্যাকেটজাত পণ্য সরবরাহ করা যাবে বলেও জানান স্থানীয় কৃষকরা।
উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর মা ডালিকা চাকমা জানান, আমার মেয়ে রাঙামাটি মহিলা কলেজে পড়ে। তাকে নানিয়ারচর সদর পর্যন্ত পৌছে দিতে হয়। এগারইল্যাছড়া থেকে তাকে আনা নেওয়া করতে অনেক কষ্ট। এই এলাকার বাসিন্দাদের হাট বাজারে, স্কুল কলেজে ও রোগী যাতায়াত করতে অনেক কষ্ট। সরকারীভাবে এই সড়কটি যাতে ভালো একটি সড়ক হয় আমি সেটার দাবি জানাই।
বাঘাইছড়ি এলাকার এক স্কুল শিক্ষক জানান, পাহাড়ের অনেক ছেলে মেয়েই পড়ালেখাই খুবই ভালো করে। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকায় তাদের মেধার বিকাশ হয়না। রাঙামাটির সাথে বাঘাইছড়ির যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হলে এই এলাকার মানুষের আত্ম সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হবে এলাকার মানুষ।
এবিষয়ে লংগদু উপজেলা বিএনপির সভাপতি তোফাজ্জল চেয়ারম্যান জানালেন, এই একটি সড়ক হলে লংগদুর সাথে সারাদেশের যোগায়োগ ব্যবস্থা দুই থেকে আড়াই ঘন্টা কমে যাবে। এলাকার জেলেরা মাছ ও কৃষকরা কৃষিজাত পণ্যসহ সকল পাহাড়ি পণ্যের সঠিক দামও পাবে এবং দেশবাসিও মান সম্পন্ন পণ্য পাবে কম সময়ে। পর্যটন বিকাশের সম্ভাবনা তো রয়েছেই।
নানিয়ারচর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. নুরুজ্জামান বলেন, নানিয়ারচরে সেতু হলেও আজো নির্মাণ হয়নি নানিয়ারচর-লংগদুর এই জনগুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি। এই সড়কটি নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।
এবিষয়ে জানতে চাইলে নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আমিমুল এহসান খান জানান, নানিয়ারচর-লংগদু সড়কটি শুধুমাত্র নানিয়ারচর-লংগদুর জন্য না, এতদাঞ্চলের জন্য বিশেষ করে বাঘাইছড়ি ও দিঘিনালাসহ আমাদের সাজেক কেন্দ্রীক যে পর্যটন রয়েছে, সে ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হবে।
রাঙামাটি জেলা পরিষদ সদস্য মিনহাজ মুরশীদ জানান, রাঙামাটির লংগদু ও বাঘাইছড়ি দুর্গম একটা এলাকা। রাঙামাটি থেকে নানিয়ারচর হয়ে লংগদু যেতে যেখানে ৩০কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলেই যাওয়া সম্ভব। সেখানে এখন খাগড়াছড়ি হয়ে ১০০-১২০কিলোমিটার অতিরিক্ত সড়ক ব্যবহার করতে হয়। নানিয়ারচর-লংগদু সড়কটি ইতোমধ্যে সরকার কিছুটা কাজও করেছে, কিন্তু তারপর কেন কাজটি আর এগুচ্ছে না এটাই জনগণের প্রশ্ন।
এবিষয়ে রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা জানান, বগাছড়ি-নানিয়ারচর-লংগদু সড়কটি একটি জেলা মহাসড়ক। এই সড়কের দৈর্ঘ ৩৭দশমিক ৫কিলোমিটার। বগাছড়ি থেকে নানিয়ারচর পর্যন্ত ১৮কিলোমিটার পাকা সড়কে উন্নত করা হয়েছে। বাকি ২৪কিলোমিটার সড়ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে উন্নয়নের জন্য একটা ডিও লেটার প্রেরণ করা হয়েছে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের থেকে সে বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। আমরা সড়কটির গুরুত্ব তুলে ধরে একটি প্রকল্প প্রনয়নের সুপারিশ করেছি। আশা করছি খুব দ্রুতই এটার একটা ইতিবাচক ফলাফল আসবে।