আরিফুর রহমান স্বপন, কুমিল্লা প্রতিনিধি
আগামীকাল ২৮ অক্টোবর বৃহত্তর কুমিল্লার প্রথিতযশা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, সবেক গণপরিষদ সদস্য আবদুল আউয়ালের ১৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী। এ উপলক্ষে লাকসামে পারিবারিক ও দলীয় ভাবে কোরআনখানী, মিলাদ মাহফিল ও প্রয়াত নেতার সমাধীতে পুস্পস্তবক অর্পণের আয়োজন করা হয়েছে।
প্রয়াত ওই নেতা ১৯২১ সালের ১ জুলাই চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার চেঙ্গাচাল নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম ছায়েদা খাতুন ও বাবা মৌলভী ছাঈয়েদ আহমদ। গণপরিষদ সদস্য মরহুম আব্দুল আউয়াল ১৯৩৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৩৮ সালে লাকসাম উপজেলা মুসলীম ছাত্রলীগে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩৯ সালে লাকসাম উপজেলা মুসলীম ছাত্রলীগের অস্থায়ী সভাপতি এবং ১৯৪০ সালে লাকসাম উপজেলা মুসলীম ছাত্রলীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪১ সালে পাকিস্তান দিবস পালনের উদ্দেশ্যে হাজার লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন। এজন্য ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লাকসামের গাজীমুড়া আলীয়া মাদ্রাসা হতে বহিষ্কৃত হন।
১৯৪২ সালে ত্রিপুরা সদর দক্ষিণ মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং একই সময় ১৯৪২ সালে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ কাউন্সিলর সদস্য ছিলেন। ১৯৪৩ সালে ত্রিপুরা দক্ষিণ মহকুমা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৪৩ সালে ত্রিপুরা জেলা মুসলিম লীগ ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলর সদস্য হিসেবে কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের প্রতিটি সভায় যোগদান করেন। ১৯৪৫ সালে চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার অন্তর্গত রহিমানগর বাজারে এক জনসভায় -’শয়তানের হুকুমতের কবর দিয়ে তার উপর পাকিস্তানের সৌধ নির্মাণ করিতে চলিলাম’- বলে বক্তৃতা আরম্ভ করলে ব্রিটিশ সরকার তাকে সর্ব প্রথম গ্রেফতার করেন। অপর দিকে ১৯৪৯ সালের একই বছর মিস্ ফাতেমা জিন্নার নির্বাচন কালে তাকে মিথ্যা মাইক চুরির মামলায় গ্রেপ্তার করে এক মাস স্ব-গৃহে অন্তরীন রাখা হয়।
পূর্ব-পাকিস্তানে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড -এর সংখ্যা যখন ছিল প্রায় চার লক্ষ, তখন শুধুমাত্র আব্দুল আউয়াল একাই কঠোর পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন প্রায় পনের হাজার ন্যাশনাল গার্ড বাহিনী আর হাজার হাজার ছাত্র-কর্মী।
এরপর ১৯৪৯ সালে লাকসাম উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে মহকুমা আওয়ামীলীগের সম্পাদক, বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা
আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক ও প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আবদুল আউয়াল লাকসামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে নিয়ে ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৫৭ এবং ১৯৬৪ সালে জনসভার আয়োজন করেছিলেন যার অসংখ্য লিফলেট ও প্রমানাদি রয়েছে, যা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এ ক্ষেত্রে আব্দুল আউয়ালকে মুক্তিযুদ্ধের একজন ইতিহাস সংগ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করা যায় নিঃসন্দেহে।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণভবনে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা আওয়ামীলীগের কমিটি গঠন করে আব্দুল আউয়ালকে সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজনের মধ্যে আবদুল আউয়াল ছিলেন অন্যতম সহচর। প্রায়ই চিঠি পত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু খবর নিতেন আবদুল আউয়ালের। অনেকগুলো চিঠির মধ্যে ১৯৬৫ সালে আব্দুল আউয়াল-কে লেখা একটিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন- ‘ভাই আউয়াল, আপনার নিঃস্বার্থ ত্যাগের কথা সকলে ভুলতে পারে কিন্তু আমি ভুলতে পারিনা” আবদুল আউয়ালের
লাকসামের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে বাবা বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা সেই চিঠিগুলো পড়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে গিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা-বানিজ্য এমনকি ঘর-সংসার করার কথাটিও ভাবার সময় পাননি তিনি। ১৯৭৬ সালে মায়ের শেষ অনুরোধ রক্ষার্থে ৫৫ বছর বয়সে লাকসামের মিশ্রী গ্রাম নিবাসী শহীদ বুদ্ধিজীবি ডাঃ গোলাম মোস্তফার বিপত্নীক ছোট বোনকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবর পাখি ডাকা ভোরের প্রথম প্রহরে লাকসামের নিজ বাসভবনে ইতিহাসের এই মহান ব্যক্তিটি চির বিদায় নেন।