মোহাম্মদ বিন সালমান কার্যত শাসক (ডি ফ্যাক্টো) হওয়ার পর একের পর এক পরিবর্তন এসেছে সৌদি আরবে। বিশ্বের মহাপরাক্রমশালী দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করেছে রিয়াদ। এবার পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে নজর দিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)। আর সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পাওয়ার পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন তিনি। বিনিময়ে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া লাগবে সৌদি আরবের।
এক দশকের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রেখেছে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চাইছেন, এবার সেই সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক হোক। তবে এ সময়টা সৌদি আরবের জন্য ঠিক উপযুক্ত নয়। কেননা ইসরায়েলে এখন কট্টর ডানপন্থী সরকার ক্ষমতায়। এ ছাড়া জেনিনে হামলা চালানোর কারণে আরব লীগ সম্প্রতি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করেছে।
এর মধ্যেই চলতি বছরের শেষদিকে ইসরায়েল-সৌদি আরব সম্পর্কের স্বীকৃতি চাইছে বাইডেন প্রশাসন। এ জন্য বেশ কয়েকবার সৌদি যুবরাজের কাছে হাজির হয়েছেন বাইডেন প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। স্বীকৃতির বিনিময়ে মোহাম্মদ বিন সালমান কী চান- সেটিই তাঁদের জিজ্ঞাসা।
উত্তর আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছেন সৌদি যুবরাজ। স্বীকৃতির বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন চান তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন নিরাপত্তা ইস্যু, যার আওতায় আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। শুধু তাই নয়, পরমাণু অস্ত্র বানাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চান মোহাম্মদ বিন সালমান।
ইসরায়েল কি গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে?ইসরায়েল কি গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে?
প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রাচ্যে এখন পর্যন্ত পরমাণূ অস্ত্র আছে শুধু ইসরায়েলের। যদিও তা ঘোষিত নয়। ওয়াশিংটনের সরাসরি তত্ত্বাবধানেই এই পরমাণু অস্ত্রের মালিকানা পেয়েছিল দেশটি। এ নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের সাথে এক অনানুষ্ঠানিক চুক্তিতে রয়েছে ইসরায়েল। নিরাপত্তা নিশ্চয়তার নামে স্নায়ুযুদ্ধকালে এই অস্ত্রের মালিকানা পেয়েছিল দেশটি। এবার এই একই রাষ্ট্রের স্বীকৃতির অজুহাতেই সৌদির হাতে পরমাণু অস্ত্রের মালিকানা যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা রিয়াদের জন্য সম্ভাবনা হলেও বাকি বিশ্বের জন্য তা নিশ্চিতভাবেই আশঙ্কা।
এত কিছুর পরও এই চুক্তিকে কি আর ইসরায়েল-সৌদি চুক্তি বলা যায়? এটি পরিণত হয়েছে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে। আর এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে মধ্যপ্রাচ্যে আসবে আমূল পরিবর্তন।
জেনিনে ফিলিস্তিনি বাড়িগুলো সেনাঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে ইসরায়েলজেনিনে ফিলিস্তিনি বাড়িগুলো সেনাঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে ইসরায়েল
প্রতিষ্ঠার ৭২ বছরে আরবের মাত্র দুটি দেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়তে পেরেছে ইসরায়েল। ২০২০ সালে এতে যুক্ত হয় বাহরাইন, মরক্কো, সুদান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কলকাঠি নেড়েছিলেন। এবার তাঁর উত্তরসূরিও সেই পথেই হাঁটছেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়তে যাওয়া পরবর্তী আরব দেশ কোনটি হবে? এমন প্রশ্নে কূটনীতি পাড়ায় আলোচনা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। তবে সৌদি আরব হবে, তা খুব কম মানুষই ভেবেছেন। কারণ, এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ এটি। এ ছাড়া সৌদি আরব একটি মুসলিম রাষ্ট্র।
এমন চুক্তির ব্যাপারে গত বছরের ডিসেম্বরেই আলোচনা শুরু হয়। তবে সৌদি আরব তাতে সম্মত ছিল না। গত কয়েক মাসের মধ্যেই নিজেদের অবস্থান বদলায় দেশটি। তবে আরব শান্তি চুক্তিতে ইসরায়েলের সমর্থন চায় দেশটি। আর তাতে সমর্থন মানে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
তবে এ ব্যাপারে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান। এর পরিবর্তে তিনি শান্তির পথের কথা বলেন। তবে তাতে দুই পক্ষের যাতে লাভ হয়, সেই দিকেও ইঙ্গিত করেছেন তিনি।
চুক্তি ইসরায়েলের সঙ্গে করলেও দাবি-দাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই করছে সৌদি আরব। তবে এটি অস্বাভাবিক নয়। বরাবরই আরব-ইসরায়েল চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। ১৯৭৯ সালে মিসরকে ৫ হাজার কোটি ডলার দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি করিয়েছে তারা। আর আমিরাতের সঙ্গে চুক্তির সময় ট্রাম্প দেশটিকে এফ-৩৫ ফাইটার জেট সরবরাহের ঘোষণা দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েক জন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এবার সৌদি আরবের দাবি পূরণ করবে তারা। তবে পরমাণু অস্ত্রে সহায়তা করার ব্যাপারটি বিতর্কিত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। কেননা ইরানের সঙ্গে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাপে-নেউলে সম্পর্ক চলছে।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। চীন ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর করছে সৌদি আরব। আবার রাশিয়াও আছে সৌদি আরবের পাশে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবকে নিজেদের অনুকূলে আনতে সবকিছুই করতে রাজি যুক্তরাষ্ট্র। আর উপরি পাওনা হিসেবে ইসরায়েলের স্বীকৃতি মিলবে। সৌদি আরব স্বীকৃতি দিলে অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোও একই পথে হাঁটতে পারে।