পাবনার বেড়া উপজেলার কাশীনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ মাঠে এমনই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা গেছে। কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ও গবেষক ড. মো. আমিন উদ্দিন মৃধা এ উদ্যোগ নিয়েছেন।
‘একজন শিক্ষার্থী একটি সমন্বিত কৃষি খামার’ নামের একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করছেন আমিন উদ্দিন। পাইলট প্রকল্পটি সফল হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বিদেশের অনেক বিশেষজ্ঞও এ ধারণাটির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
গবেষক ড. মো. আমিন উদ্দিন মৃধা এখন ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি বাংলা মডেল’ নামে এটিকে সারাদেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছেন। এতে কৃষিতে যুগান্তকারী সাফল্য আসবে বলে মনে করেন তিনি।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কিং সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আমিন উদ্দিন মৃধা জাগো নিউজকে বলেন, দেশের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠের চার পাশ অব্যবহৃত থেকে যায়।
শিক্ষার্থীদের অনেক সময় অবসর থাকে। পাঠের মাঝে তাদের মানসিক শান্তি দিতে বা সৃজনশীল কিছু করাতে পারলে তাদের দেহ-মন দুটোই ভালো থাকবে। এ ধারণা থেকে তিনি এ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন।
প্রকল্পটির আওতায় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীকে কাজে লাগাতে চান এ গবেষক।
গবেষক আমিন উদ্দিনের এ পাইলট প্রকল্পে নানা ধরনের শাকসবজি ফলেছে। এরই মধ্যে একবার বিষমুক্ত শাকসবজি তোলাও হয়েছে। নতুন করে আবার সবজি লাগানো হয়েছে। কিছু গাছে অচিরেই ফল আসবে।
চীনের গুইঝো বিশ্ববিদ্যালয় এবং থাইল্যান্ডের মাই ফাহ লুয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করা এ কৃষিবিজ্ঞানী বলেন, তিনি তার প্রকল্পে সফল হয়েছেন। গত জুন মাসে তিনি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে এ ব্যাপারে দীর্ঘ বৈঠক করেন।
বৈঠকে প্রকল্পটি সম্পর্কে মন্ত্রীকে ধারণা দেন। মন্ত্রীও বিষয়টি জেনে তার সদিচ্ছা ও সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর থেকে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য এ ব্যাপারে একটি পত্রও ইস্যু করা হয়েছে।
আমিন উদ্দিন মৃধা জাগো নিউজকে বলেন, তার প্রস্তাবিত প্রকল্পে সরকারিভাবে কোনো বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। এমনকী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও এ মডেল বাস্তবায়নে কোনো অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। শাকসবজির সামান্য বীজ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে আনা ফলজ বা কাঠের গাছের চারা আনলেই হয়ে যাবে।
এ প্রজেক্টের অধীন কী ধরনের সবজি বা ফল চাষ করা যেতে পারে, এমন প্রশ্নে গবেষক ড. মৃধা জানান, বিভিন্ন ধরনের হর্টিকালচারাল ফসল বা হলুদ, আদা এবং অন্যান্য ছায়াময়ী গাছপালা, হরেক রকম শাকসবজি উৎপাদন এবং ফল ও কাঠের গাছ লাগানো যেতে পারে।
শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক রাস্তার পাশে এবং রেললাইনের কাছের জায়গাও এ প্রকল্পে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মনে করেন গবেষক আমিন উদ্দিন। তার মতে, শিক্ষার্থী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় হাজার হাজার মসজিদ এবং অন্যান্য প্রার্থনা স্থানের ছাদকে ফলগাছের ছাদ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
‘সজিনার বিশাল ওষুধি গুরুত্ব রয়েছে। এটি মানুষের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি একটি অলৌকিক গাছ হিসেবে বিবেচিত হয়। সজিনা গাছ পানি পরিশোধক, সবুজ সার, মাইক্রোট্রফিক উদ্ভিদ, বনজ পুনরুদ্ধার, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, পশুর খাবার ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হয়।
শিক্ষার্থীদের কাজে লাগিয়ে যদি বাংলাদেশের তিন কোটিরও বেশি পরিবারের প্রতিটি ঘরে একটি বা দুটি সজিনা গাছ লাগানো যায় তাহলে দেশে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৬০ লাখ সজিনা গাছ থাকবে’—যোগ করেন আমিন উদ্দিন মৃধা।
বজ্রপাতের হাত থেকে সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিরসনের জন্য শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে গ্রামাঞ্চলে তালগাছ রোপণের সম্ভাবনাময় একটি ধারণা এই প্রকল্পে রেখেছেন এই কৃষিবিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, সারাদেশে দুর্গম জায়গায় ক্ষেত-খামারে কৃষিকাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েন কৃষক। বজ্রপাতজনিত মৃত্যু বৃদ্ধির মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে তালগাছ এবং খেজুর গাছের ঘাটতি। তালগাছ বজ্রপাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করে।
তাই তালগাছ রোপণ করতে শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, কৃষক এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা নেওয়া গেলে লাখ লাখ তালগাছ রোপণ করা সম্ভব হবে। আমিন উদ্দিন বলেন, ‘কৃষকের ছাউনি’ খুব দরকারি। আর এ ছাউনি হতে পারে তালগাছ।
পাবনার বেড়া উপজেলার কাশীনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ মাঠে ড. আমিন উদ্দিন মৃধার পাইলট প্রকল্পটি এরই মধ্যে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কলেজের ভেতরে-বাইরে এখন যেন সবুজের মেলা। কলেজের ছাদ থেকে শুরু করে বারান্দা বা অফিস কক্ষ সব জায়গা নানা জাতের গাছ দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো। কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও দুলাই সরকারি কলেজের প্রভাষক সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, একজন শিক্ষার্থী তার অবসর সময়ে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছেন। এতে সবজি বা ফলচাষের প্রতি তার একটা অভিজ্ঞতা ও হৃদ্যতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এ চর্চা তার বাড়ির আঙিনায় বা ছাদে হবে। এটি তার সংসার জীবনেও কাজে লাগবে।
আমিনপুর থানার কদিমালঞ্চি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান বলেন, এটি একটি অনন্য মডেল। মডেলটি সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু হলে একটি নীরব সবজি বা ফল বিপ্লব হয়ে যাবে।
কাশীনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির মহিমা খাতুন ও ইসরাত জাহান বন্যা জাগো নিউজকে বলেন, তারা কলেজে সবজি ও ফলগাছের পরিচর্যা করেন। করোনাকালীন কলেজে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে এসেও তারা বাগান ঘুরে দেখে যেতে ভুল করেননি। এতে তাদের ভালো লাগা তৈরি হওয়ায় নিজ বাড়িতেও তারা এখন সবজি ও ফল চাষ করছেন।
এ প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের সমন্বয়কারী শিক্ষক আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, আমি আনন্দের সঙ্গে মৃধা স্যারের উদ্ভাবিত পাইলট প্রকল্পে কাজ করছি। পাইলট প্রকল্পটি সফল হওয়ায় আমি আনন্দিত।
কলেজের অধ্যক্ষ রোকসানা খানম বলেন, পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে ধারণাটি সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হলে এ মডেলটি পরিপূর্ণতা লাভ করবে।