রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ট শ্রেণীর ছাত্রী পূর্নিমা চাকমা। যে বয়সে একজন মেয়ে বাবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাবার কথা, নানা কিছু বায়না ধরার কথা, খেলাধুলা কিংবা কোন বিনোদন কেন্দ্রে গিয়ে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া, কিন্তু তেমনটি জীবনে আসে নাই পূণিমা চাকমার জীবনে। হয়তো বাবা মায়ের দেওয়া আদর ভালোবাসা তাঁর জীবনে কখনো আসবে না। কারন ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল সকলকে অকুল সাগরে ভাসিয়ে পরপারের বাসিন্দা হন তাঁর বাবা জ্যোতিষ চাকমা। তবে তাঁর বেঁচে থাকা মা স্বপ্না চাকমার গল্প একটি শুনাতে হয়। এইযেন গল্প নয়, প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে রচিত হয়েছে বেদনার ইতিহাস।
১৯৯৮ সালের মে মাসের কোন এক সময়, চন্দ্রঘোনা কুষ্ঠ হাসপাতাল এ কুষ্ঠ রোগ নিয়ে ভর্তি হন চট্রগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলাধীন নোয়াপাড়া মাষ্টার দা সূর্য্যসেন পল্লীর স্বপ্না দাশ। এরই মধ্যে কুষ্ঠ হাসপাতাল এর তত্ত্বাবধানে বিনাখরচে তার চিকিৎসা চলছে ভালোমতই। কিন্ত নিয়তির কি বিধান। কুষ্ঠ রোগের কারনে দুই পায়ে ক্ষত দেখা যাওয়ায় ২০০৪ সালে পূর্ণিমার মা স্বপ্নার দুই পা কেটে ফেলতে হয় ডাক্তারদের পরামর্শে। তবে এরই মধ্যে ভালোবেসে ফেলে হাসপাতাল এ চিকিৎসাধীন আর এক কুষ্ঠরোগী জ্যোতিষ চাকমাকে। ১৯৯৯ সালে রাউজানের স্বপ্না দাশ জ্যোতিষ চাকমাকে বিয়ে করে স্বপ্না চাকমা নামে ঘর করে থাকেন সুন্দরভাবে। চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টান ও কুষ্ঠ হাসপাতাল এর পরিচালক ডা: প্রবীর খিয়াং তাদেরকে কুষ্ঠ হাসপাতাল এর কোয়াটারে সম্পূর্ণ বিনা ভাড়ায় থাকার ব্যবস্হা করেন। দীর্ঘদিন ধরে, এই ছাড়া বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং ঔষধ প্রদান করেন তিনি।
স্বপ্না চাকমার এক ছেলে আকাশ চাকমা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে এখন বাসের হেলপারের কাজ করে আর এক মেয়ে পূর্নিমা চাকমা চন্দ্রঘোনা পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়ছে। প্রতিদিন হুইল চেয়ারে করে স্বপ্না বনগ্রাম এলাকায় কাঁচা শাকসবজী নিয়ে বিক্রি করে জীবন ধারন করেন। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল সকলকে অকুল সাগরে ভাসিয়ে পরপারের বাসিন্দা হন তাঁর স্বামী জ্যোতিষ চাকমা। চোখে সর্ষে ফুল দেখার মতো অবস্হা তাঁর।
মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৮ কাপ্তাই – চট্টগ্রাম সড়কের কুষ্ঠ হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তায় দেখা মিলে স্বপ্না ও তাঁর মেয়ে পূর্ণিমার। এই সময় পূর্ণিমা চাকমা স্কুলে যাবার আগে, হুইল চেয়ারে করে মা’ কে শাক সবজি বিক্রি করতে বসিয়ে দিতে যাচ্ছেন। এরপর সেই স্কুলে যাবে। আবার স্কুল বন্ধ থাকলে সকাল হতে সন্ধ্যা অবধি সেই মা’ কে ব্যবসার কাজে সহায়তা করেন।
স্বপ্না হুইল চেয়ারে বসে কিছু শাকসবজী নিয়ে বিক্রি করতে করতে স্বপ্না এই প্রতিবেদককে জানান, প্রতিদিন রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কাপ্তাই সড়কের লিচুবাগান বনগ্রাম মুল রাস্তার পাশে সবজি বিক্রি করতে বসি। কোনদিন ৫০০ কোনদিন ৩০০ আবার কোনদিন ২০০ টাকা বিক্রি হয় তার। বাজারে এখন আশেপাশে অনেক অস্থায়ী দোকান বসার কারনে আগের মতো বিক্রি নেই। এইভাবে খুব অর্থকষ্টে ২ ছেলেমেয়েদের নিয়ে জীবনের কারনে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। কান্না জড়িত কন্ঠে স্বপ্না বলেন, এই বয়সে একজন মেয়ে আনন্দ করবে, খেলাধুলা করবে, প্রানবন্ত থাকবে। কিন্তু, মেয়ের সেই শখ আমি পূরণ করতে পারি নাই।
কথা হয়, পূর্ণিমা চাকমার সাথে, সেই স্কুলে যাবার জন্য তাড়াহুড়া করছেন। এইসময় সে বললো, খুব ইচ্ছে হয় স্কুল শেষে মাঠে খেলাধুলা করবো, ভালো পোশাক কিনবো, শহরে গিয়ে শিশু পার্ক দেখবো। কিন্তু কোন কিছু আমার জীবনে আসে নাই। তবে একটা সুখ তাঁর পুরণ হচ্ছে। সে জানালো, আমি বনগ্রাম জুম পাড়া চার্চে প্রতি রবিবার বিকেলে সঙ্গীতা ম্যাডামের কাছে নাচ শিখছি। গত মাসে কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির একটা প্রোগামে আমি নাচ করেছি। কি আনন্দ লেগেছে। এই নাচ শেখার পেছনে আমার কোন টাকা পয়সা লাগে না। সবকিছু ব্যবস্থা করে দেন আমাদের মিশন এলাকার অনুপ দাদু। আমিও চাই অন্যান্য বন্ধু বান্ধবদের মতো খেলতে, ঘুরতে।
এম/এস