রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী দুটি গাছ। একটি কড়ই, আরেকটি নিম। নানা কারণেই প্রেমতলী বাজার আর এই গাছ দুটি ঐতিহাসিক। গাছ দুটিকে ঘিরে এলাকার নবীন-প্রবীণদের রয়েছে কত শত স্মৃতি! সরকারি সেই গাছ দুটিকেই হঠাৎ কাটার সিদ্ধান্ত নেয় একটি প্রভাবশালী মহল।
গাছ দুটির প্রাণ রক্ষার আকুতি নিয়ে এলাকার কলেজছাত্র সাইফুল ইসলাম ফোন করেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের রাজশাহীর একজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে। কিন্তু সওজ কর্মকর্তা বিষয়টিকে গুরুত্বই দেননি প্রথমে। তাই সরকারের অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার (জিআরএস) ওয়েবসাইটে গিয়ে অভিযোগ করেন সাইফুল। এর ঘণ্টাখানেক পরই সওজের ওই কর্মকর্তা সাইফুলকে ফোন করে জানান, কেউ কাটতে পারবে না গাছ দুটি। তিনি লোক পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
ঘটনাটি গত ২৬ এপ্রিলের। জিআরএসে করা অভিযোগের কারণে প্রত্যন্ত গ্রামের ঐতিহাসিক গাছ দুটি কাটা না পড়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। অভিযোগকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সওজ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে সাড়া পাইনি। তাই জিআরএসে গিয়ে অভিযোগ করি। আর এই কারণেই আমাদের আবেগের গাছ দুটি বেঁচে যায়। জিআরএস ছিল বলই হয়তো গাছ দুটিকে বাঁচাতে পেরেছি।’
সাইফুল ইসলামের মত জিআরএস-এর সুবিধা পেয়েছেন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের রাজশাহী ব্যুরো প্রধান আবরার শাঈর। তিনি জানান, তাঁদের এলাকায় বেশিরভাগ সময়ই বিদ্যুতের ভোল্টেজ কম থাকত। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলেও যেত। তিন মাস ধরেই এমন অবস্থা চলছিল। এই গরমে তাঁরা কাহিল হয়ে পড়ছিলেন। তাই নেসকোর হটলাইনে কল দিয়ে অভিযোগ জানান। সেখান থেকে ‘দেখছি’ বলা হলেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই ফোন করেন নেসকোর ঊর্দ্ধতন এক প্রকৌশলীকে। তিনি আরেকটি ফোন নম্বর দেন। সেই নম্বরে কলই ঢুকছিল না। বাধ্য হয়ে গত ২৫ এপ্রিল সকাল ৮টায় সরকারের অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার ওয়বেসাইটে গিয়ে মনের সব কথা সবিস্তরে লেখেন। তারপর দুই ঘণ্টার মধ্যেই সমাধান হয় বিদ্যুতের সমস্যার। নেসকোর কর্মকর্তা তাকে অন্তত চারবার কল দিয়ে জানতে চান সংযোগ ঠিক আছে কি না। এমনকি তারা বাড়িতে গিয়েও দেখে আসেন ভোল্টেজ।
আবরার শাঈর বলেন, ‘আমি এর আগেও জিআরএসের সহায়তা নিয়েছিলাম। সেবারও সুফল পেয়েছিলাম। অনেকেই এখন জিআরএসে অভিযোগ করে প্রতিকার পাচ্ছেন। এটি সরকারের একটা ভাল উদ্যোগ। তবে এ বিষয়ে আরও প্রচারণা দরকার।’
জিআরএসের পূর্ণরূপ হচ্ছে- গ্রিভেন্স রেড্রেস সিস্টেম। সংক্ষেপে একে বলা হয় জিআরএস। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিকল্পনায় এখন এই সিস্টেমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণ করা হয়। সরকারী সেবা না পেলে মৎং.মড়া.নফ নামের ওয়েবসাইটে গিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন যে কেউ। আর তখন সঙ্গে সঙ্গেই নেওয়া হয় পদক্ষেপ। অভিযোগ গ্রহণ থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত সবই অভিযোগকারীকে জানানো হয় এসএমএসের মাধ্যমে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে অভিযোগ গ্রহণের এই প্রক্রিয়া যুগান্তকারী পদক্ষেপ মনে করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দীন। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের অভিযোগ শুনতে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটি ভাল উদ্যোগ। এখন কোথাও সেবা না পাওয়া গেলে মনের দুঃখটা জিআরএসে বলা যায়। পদক্ষেপও নেওয়া হয় তড়িৎ। সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সরকারী কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা সৃষ্টিতে এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।’
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরউল্লাহ বলছেন, ‘এখন ডাকবক্সে অভিযোগ করার দিন শেষ। মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। সরকারী কোন দপ্তরে কাক্সিক্ষত সেবা না পেলেই অনেক মানুষ হাতের মোবাইল ফোনটার সাহায্যেই জিআরএসের মাধ্যমে অভিযোগ জানান। জিআরএসের মাধ্যমে আমি মাঝে মাঝেই এ ধরনের অভিযোগ পাই। তারপর দ্রুতই সেই সমস্যার সমাধান করা হয়ে থাকে।’
জিআরএসের পরিকল্পনা, নকশা ও উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এটুআই গ্রোগ্রামের ডিরেক্টর (ই-সার্ভিস) ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ন কবীর। এর উপকারিতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরেই প্রথম কাজ ছিল সরকারী প্রতিষ্ঠান কি কাজ করছে, কি সেবা দিচ্ছে সেটা জনগণকে জানানো। আগে ম্যানুয়ালি জানানোর ব্যবস্থা ছিল। পরে ডিজিটাইলেজেশনের ব্যবস্থা করা হয়। এর অংশ হিসেবে অভিযোগ গ্রহণও ডিজিটালাইজড করা হয়।’
ড. দেওয়ান বলেন, ‘সিটিজেন চার্টার থেকে শুরু করে জিআরএস এই উদ্যেগগুলো হাতে নেওয়া হয়। ডাকবক্স বা ই-মেইলের মাধ্যমে আগেও অভিযোগ দায়ের করা যেত। তবে সেই অভিযোগগুলো ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তার কাছে পৌঁছাতে কিংবা নিষ্পত্তি হতে দেরি হত। সে কারণেই এটা অনলাইনে করা হয়েছে। জিআরএসের মাধ্যমে অভিযোগ করা যায় দ্রুত, আবার দ্রুত সমাধানও পাওয়া যায়। আমরা এটির আরও প্রচারের চেষ্টা করছি।
এম/এস