চাঞ্চল্যকর বাঁশখালীর ৩১ জেলে হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। তদন্ত শেষে ৮ বছর পর এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। সিআইডির প্রতিবেদন থেকে বাদ পড়েছিল ছনুয়া সালাম বলীর বাড়ির মোস্তাক আহমদের পুত্র বর্তমান চেয়ারম্যান এম হারুনুর রশীদ ও ছনুয়া মাতব্বর পাড়ার মৃত আবদুল হকের পুত্র ৬নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার নাছির উদ্দীন। এই দু’জন সহ মোট ৪০ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র আমলে নিয়েছেন আদালত। ১ ডিসেম্বর আদালতে ওই চার্জশিট গ্রহণের ওপর শুনানি হয়।
তদন্ত সংশিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এ ঘটনার আলোচিত ‘চরিত্রের’ নাম বাঁশখালীর ছনুয়া ইউনিয়নের সেই বিতর্কিত চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশিদ। আদালতে গ্রেফতার আসামি ওয়াসিমের দেওয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ৩১ জেলে হত্যার নেপথ্যে অন্যান্য অপরাধীদের পাশাপাশি চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদের নাম উঠে আসলেও ‘রহস্যজনক’ কারণে ঘটনায় তার সম্পৃত্ততার বিষয়টি তুলে আনতে পারেননি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। উপরন্তু হারুনকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিতে আদালতে ‘প্রার্থনা’ করেন এ কর্মকর্তা। এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট থেকে প্রকৃত আসামিদের বাদ দেয়ারও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
এ ঘটনায় নিহত আবদুর নুরের পিতা শেখেরখীলের বদিউল আলম অভিযোগ করে বলেন, ‘সিআইডি’র কর্মকর্তা প্রকৃত আসামিদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে চার্জশিট থেকে তাদের বাদ দিয়েছেন। আবুল হোসেন ও নুর মোহাম্মদ নামের দু’জন নিরীহ ব্যক্তির নাম চার্জশিটে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে আমি ও জিআর মামলার বাদি আমার মামাতো ভাই শাহাব দ্দিন সিআইডি’র কর্মকর্তা নুরুল আমীনের সাথে বিষয়টি নিয়ে আদালত চত্বরে বাহাস হয়েছে। প্রকৃত আসামিদের বাদ দেয়ার ব্যাপারে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।’
তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য
প্রকৃত আসামিদের কাছ থেকে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে- বাদি ও ভুক্তভোগীর এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা কক্সবাজার সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার মো. নুরুল আমীন বলেন, ‘তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদেরকে চার্জশিটে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। আসামিদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে চার্জশিট থেকে তাদের নাম বাদ দিয়েছি বলে বাদি পক্ষের যে অভিযোগ তা সঠিক নয়।’
চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত করেন কুতুবদিয়া থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম খান, এসআই মো. আবুল কালাম, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, কক্সবাজার জেলার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, একই ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার মো. নুরুল আমীন, পুলিশ পরিদর্শক ফখরুল ইসলাম এবং এসআই মো. হাসান জাহাঙ্গীর।
চার্জশিটে অভিযুক্ত এবং জেলহাজতে থাকা আসামিরা হলেন-বাঁশখালীর দক্ষিণ গণ্ডামারার রুহুল কাদের ওরফে কালা মিয়ার ছেলে মো. ওয়াসিম (৪৪), পূর্ব চাম্বলের মৃত আবদুর রশিদের ছেলে মো. ফেরদৌস (৪৯), শেখেরখীল কাচারি পাড়ার আহমদ কবির ওরফে আহমদ্যা (৫৫), গণ্ডামারা ইউপি’র পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার মো. নবী হোসেন ওরফে ওরফে কসাই নবীর ছেলে মঞ্জুর আলম (২৪), ছনুয়া খুদুকখালী এলাকার মৃত নুর আহমদের ছেলে আবদুল জব্বার ওরফে আঙ্গুলকাটা জব্বার (৫৬), কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার দক্ষিণ ধুরুং এলাকার ওবায়েদ উল্লাহ্ ওরফে ওবায়েদ ডাকাত (৩৮)।
এছাড়াও জামিন নিয়ে পলাতক আছেন ২২জন আসামি। তারা হলেন-কক্সবাজার মহেশখালী উপজেলার চরপাড়া এলাকার মৃত আবদুল জলিলের ছেলে লাল মিয়া ওরফে লালু (৪৭), একই উপজেলার কালামারছড়া ইউপি’র উত্তর নলবিলা এলাকার মৃত আবদুল গণির ছেলে মোজাম্মেল ওরফে শেকু (৩৫), কুতুবদিয়া উপজেলার গফুর ওরফে গফুর (৪০)(পালক পিতা ছনুয়া আবাখালী এলাকার মাহবুবুল আলম), বাঁশখালীর ছনুয়া ইউপি’র খুদুকখালী এলাকার মৃত মো. আলীর ছেলে আবদুল হাকিম ওরফে বাইশ্যা (৪৫), খাটখালী নদীর পাড় এলাকার আবুল হোছেনের ছেলে নুরুল কাদেও (৫৫), গণ্ডামারা ইউপি’র পূর্ব বড়ঘোনা এলাকার মৃত মোক্তার আহমদের ছেলে জাকের আহমেদ (২৭), একই এলাকার মৃত ফজল আহমদের ছেলে আক্তার হোসেন (৩৪), গণ্ডামারা ইউপি’র পশ্চিম বড়ঘোনার মৃত ইসলাম মিয়ার ছেলে আমিন ওরফে আমিন ডাকাত (৪৩), একই এলাকার মৃত আবদুর রশিদের ছেলে জসিম উদ্দিন (৩৪), আবদুর রশিদ ওরফে বাইশ্যার ছেলে মো. রফিক, পূর্ব বড়ঘোনার মৃত আবদুস সালামের ছেলে মমতাজ ওরফে মন্তাজ মাঝি (৫৬), একই এলাকার মৃত মোক্তার আহমদের ছেলে কামাল উদ্দিন ওরফে কামাল মাঝি (৫০), মৃত মোজাফফর আহমদের ছেলে এরফানুল হক ওরফে এরফান (৪৪), আবদুস শুক্কুর ওরফে আবদুল্লাহর ছেলে রবি আলম ওরফে ছোট রবি (৪৩), শাহ আলমের ছেলে মোর্শেদ ওরফে বাদুইল্যা (৩২), মৃত কালু সিকদারের ছেলে আবু বক্কর (৩৫)।
অভিযুক্ত ৪০জনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মারা গেছেন
বাঁশখালী উপজেলার উত্তর কবলা পাড়ার মৃত ইউসুফের ছেলে দিদারুল ইসলাম ওরফে ডাকাত দিদার (৩২), পশ্চিম বড়ঘোনার জাকের হোসেনের ছেলে আরিফ (৩২), একই এলাকার মৃত মোক্তার আহমদের ছেলে আমান উল্লাহ্ (৩৭), মৃত আলী আহমদের ছেলে আলম ডাকাত (৪৫), ছনুয়া ইউনিয়নের হাজী কালামিয়া পাড়ার শাহ আলমের ছেলে বাহাদুর ওরফে বাহাদুর ইসলাম (৩৯), পূর্ব বড়ঘোনার মৃত আবদুল জব্বারের ছেলে মো. ইয়াছিন, পূর্ব গণ্ডামারার আবুল হাশেমের ছেলে সোহাগ (৩৭), দক্ষিণ গণ্ডামারার মৃত ফয়েজ আহমদের ছেলে মো. জমির ওরফে তারেক মাঝি (৪৫), মৃত আবুল বশরের ছেলে মামুন (৩২), মৃত শফিকুর রহমানের ছেলে রবি আলম (৪৮), গণ্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনার মৃত কালু মেম্বারের ছেলে মো. রবিউল আলম ওরফে রবি আলম (৩৬), আলী হাছানের ছেলে মো. সেলিম (৩০), দক্ষিণ গণ্ডামারার মৃত বেলায়েত হোসেন ওরফে নুর আহমদের ছেলে আলী আকবর ওরফে আকবর হোসেন ওরফে আকবর ড্রাইভার(৪৫), কুতুবদিয়া থানার লঞ্চঘাট এলাকার নুরুল আলম ওরফে মাইন্যা’র ছেলে হোসাইন (২৫), মহেশখালী মাতারবাড়ি এলাকার হংস মিয়াজি পাড়ার জকির আহমদের ছেলে বশির আহমদ (৫০)।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৩ মার্চ সকালে বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখিল ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড গুইল্লাখালী এলাকার বাসিন্দা মৃত নুরুল আলমের ছেলে নেজাম উদ্দিনসহ ১২ মাঝিমাল্লা ‘আল্লাহর দান’ নামক ফিশিং বোট নিয়ে কুতুবদিয়া চ্যানেলের ২২ কিলোমিটার পশ্চিমে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। পরের দিন ২৪ মার্চ দিবাগত রাতে তারা ১৫/১৬ মণ ইলিশ আহরণ করেন। পাশাপাশি ‘আল্লাহর দান-১’ ও ‘আল-মক্কা’ নামে আরও দুটি ফিশিং বোটও মাছ ধরেন। এসময় ৩০/৩৫জন অজ্ঞাতনামা জলদস্যূ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিন ফিশিং বোটে হামলা চালান। বোটের অধিকাংশ মাঝি-মাল্লাদের হাত-পা বেঁধে সাগরে ফেলে দেয়। কিছু মাঝিকে অপহরণ করে মাছসহ দুটি ফিশিং বোট নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ ডাকাতের দল। এসময় ‘আল্লাহর দান-১’ ফিশিং বোটের মাঝি নুর হোসেন অন্য একটি বোটে উঠে গেলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ডাকাতদের গুলিতে কয়েকজন জেলে আহত হন। নুর হোসেনসহ প্রাণে বেঁচে যান তিনজন। ৩১জন জেলেকে হাত-পা বেঁধে সাগরে ফেলে হত্যা করা হয়। ঘটনার ৮দিন পর ১ এপ্রিল দুপুরে মামলার বাদি বঙ্গোপসাগরের জাহাজখারী নামক স্থানে তার ভাই নেজাম উদ্দিনসহ ইউনুচ ও মতিন মাঝির হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মরদেহ দেখতে পান। তাদের লাশ নৌকায় তুলে বাঁশখালী থানা পুলিশকে খবর দেন তিনি। এরপর শেখেরখীল ফাঁড়িরমুখ এলাকায় লাশগুলোর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ। এ ঘটনায় দণ্ডবিধি ৩৯৬ ধারায় কুতুবদিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত নেজাম উদ্দিনের ছোটভাই শাহাব উদ্দিন। মামলার এজাহারে বলা হয়, জলদস্যূদের হাতে অপহৃত দুটি ফিশিং বোটের ৩১ মাঝিমাল্লার মধ্যে ৩জনের লাশ পাওয়া যায়। বাকি ২৮জনের কোন হদিস মেলেনি। বাদি শাহাব উদ্দিনের অভিযোগটি বাঁশখালী থানার মাধ্যমে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া থানা গ্রহণ করে নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করেন। মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন কুতুবদিয়া থানার এসআই আবুল কালাম। অভিযোগপত্রে বলা হয়, তিনটি ফিশিং বোটের ৩৪জন মাঝিমাল্লাদের মধ্যে শুধু তিনজন জীবিত ফেরত আসে। বাকি ৩১জনের মধ্যে ২৮জন জেলের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর ২৮ মৃতদেহের মধ্যে ২১জনের সুরতহাল তৈরি করে কুতুবদিয়া থানা পুলিশ। বাকি ৭জনের সুরতহাল তৈরি করে মহেশখালী থানা পুলিশ। এরপর জলদস্যূদের ফেলে যাওয়া দুটি ফিশিং বোট উদ্ধার করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবুল কালাম। দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ৩১জন জেলে হত্যা মামলাটি তফসিলভুক্ত হওয়ায় ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি এ মামলার তদন্তভার নেন কক্সবাজার সিআইডি’র পুলিশ পরিদর্শক ফখরুল ইসলাম। তিনি বদলির পর ২০১৬ সালের ১৪ মে মামলার তদন্তের দায়িত্বপান একই সংস্থার এসআই হাসান জাহাঙ্গীর। ২০১৮ সালের ৩০জুন হাসান জাহাঙ্গীর পিবিআইতে বদলি হয়ে গেলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্বপান একই সংস্থার সহকারী পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান। কিছুদিন পর এ কর্মকর্তাও সিআইডি’র ফেনী ইউনিটে বদলি হওয়ায় সর্বশেষ এ মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান একই সংস্থার সহকারী পুলিশ সুপার মো. নুরুল আমীন। ২০১৯ সালের ২৫ মে তিনি এ মামলা তদন্তের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
জানা গেছে, ৩১ জেলে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পেশাদার ডাকাত আবদুর রহিম, মো. জব্বার, মকসুদ, আহমদ উল্লাহ, নেজাম উদ্দিন ওরফে নেজাইম্মা ডাকাত, শেকুব ওরফে শেকু, রমিজ আহমদ, ইসহাক, ইউনুছ, সালেহ আহমদ, গিয়াস উদ্দিনসহ এ যাবত ৩১জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং সিআইডি। এর মধ্যে অনেকে আদালত থেকে জামিন নিয়ে পলাতক হয়ে গেছে। গ্রেফতার হওয়া কিছু আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ না মেলায় মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিতে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এদিকে গ্রেফতারের পর ২০১৩ সালের ১৬ জুন সাগরে ৩১ মাঝিমাল্লা হত্যার দায় স্বীকার করে বাঁশখালীর ম্যাজিস্ট্রেট আমিরুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন আসামি মো. ওয়াসিম (৩০) নামের এক জলদুস্য। বাঁশখালীর গণ্ডামারা এলাকার বাসিন্দা ওয়াসিমকে গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ওয়াসিম জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, তাদের (ডাকাতদের) চিনে ফেলায় ৩১ মাঝিমাল্লাদের হত্যা করা হয়। জবানবন্দিতে তিনি ৩৫ জনের নাম উল্লেখ করেন।