অসীম রায়,বান্দরবান প্রতিনিধিঃ সময় পাহাড়ের পর পাহাড়ে শোভা পেত জুম চাষ। জুম চাষে ব্যস্ত সময় কাটাতো পাহাড়ের জুমিয়ারা। সময়ের ব্যবধানে পাহাড়ি টিলা ভূমিতে জুম চাষ নিয়ে ব্যস্ত থাকা সেই জুমিয়ারা আগাম আনারস চাষে সাফল্যের স্বপ্ন দেখছে।
আনারস বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য বেশ উপযোগী। তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান পাহাড়ী অঞ্চলে আনারস চাষাবাদের জন্য বেশি উপযোগী।
আনারসের বেশ কয়েকটি জাত আছে। এর মধ্যে হানিকুইন, জায়েন্ড কিউ, এমডি-২, ঘোড়াশাল ও ক্যালেন্ডার জাত অন্যতম।
হানিকুইন ডলডুপি হিসেবেও পরিচিত। চোখ সূচালো ও উন্নত। গড় ওজন প্রায় ১ কেজি। পাতা কাঁটাযুক্ত ও পাটল বর্ণের। হানিকুইন বেশ মিষ্টি আনারস। মধুর মতোই মিষ্টি। পাকা আনারসের শাঁস হলুদ রঙের। চোখ সূচালো ও উন্নত।
সবচেয়ে বড় আকারের জাত হচ্ছে জায়ান্টকিউ। নামের সাথে মিল রেখেই এর আকারও বড় আকৃতির। পাকা অবস্থায়ও আনারস সবুজাভ শাঁস হালকা হলুদ। চোখ প্রশস্ত ও চেপ্টা। গাছের পাতা সবুজ ও প্রায় কাটাবিহীন। গড় ওজন ২ কেজি।
ক্যালেন্ডুলা আরেকটি জাত। মাঝারি আকারের ভালোই মিষ্টি। ওজন ১ থেকে দেড় কেজি।
পাকা আনারস লালচে এবং ঘিয়ে সাদা হয়। চোখ প্রশস্ত। পাতা কাঁটা বিশিষ্ট, চওড়া ও ঢেউ খেলানো থাকে। গড় ওজন ১ থেকে ১.২৫ কেজি। বেশ মিষ্টি। এগুলো ছাড়া দেশীয় হয়তো আরও জাত থাকতে পারে যেগুলো বাড়ির আঙিনার আশপাশে জন্মে।
ফিলিপাইনের এমডি-২ জাতের আনারস প্রাকৃতিকভাবেই দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায়। দেশে বর্তমানে উৎপাদিত আনারস যেখানে পাকার পর মেয়াদ থাকে এক সপ্তাহ, সেখানে এমডি-২ জাতের আনারস এক মাস সংরক্ষণ করা যায়। তাই এ আনারস বিদেশে রপ্তানি করা সহজ হবে।
স্বাভাবিক অবস্থায় আনারসের বীজ হয় না। তাই বিভিন্ন ধরনের চারার মাধ্যমে আনারসের বংশবিস্তার হয়। সাধারণত পার্শ্ব চারা, বোঁটার চারা, মুকুট চারা ও গুঁড়ি চারা দিয়ে আনারসের বংশবিস্তার হয়। এর মধ্যে পার্শ্ব চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। আনারসের বিভিন্ন জায়গা থেকে চারা উৎপন্ন হয়।
সব ধরনের চারাই ব্যবহার করা যায় চাষের জন্য। পাতার কক্ষ থেকে, মাটির কাছের পাতার কক্ষ থেকে, ফলে বোঁটার পাশ থেকে, মাথার মুকুট বা পুরনো গাছের গোড়া থেকে চারা পাওয়া যায়। পাতার কক্ষ থেকে পাওয়া চারা বেশি ভালো। আনারস গাছে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের চারা উৎপন্ন হয়। পার্শ্ব চারা, বোঁটার চারা, মুকুট চারা, গোড়ার চারা বা ট্যাম্প। সব ধরনের চারাই রোপণ করা যায়, তবে পার্শ্ব চারা ও গোড়ার চারাই উত্তম।
উঁচু জমি ও পানি দাঁড়ায় না দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি আনারস চাষের জন্য বেশ উপযোগী। মাটি ঝুরঝুরে করে মই দিয়ে জমি সমতল করতে হয় যাতে বৃষ্টির পানি কোনো স্থানে জমে না থাকতে পারে। জমি থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু এবং ১ মিটার প্রশস্ত বেড তৈরি করতে হবে। এক বেড থেকে অন্য বেডের মধ্যে ৫০-১০০ সেন্টিমিটার ফাঁক রাখতে হবে। পাহাড়ের ঢাল আনারস আবাদে বেশ উপযোগী। পাহাড়ের ঢালে আনারসের চাষ করার জন্য কোনোক্রমেই জমি চাষ দিয়ে বা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আলগা করা উচিত নয়। এতে ভূমিক্ষয়ের মাধ্যমে উর্বর মাটি ধুয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শুধু পাহাড়ের জঙ্গল বা আগাছা মাটির স্তরে কেটে পরিষ্কার করে জমি চারা রোপণের উপযোগী করে তুলতে হবে।
গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে আনারস চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরন অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈবসার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে।
বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশী যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যায়। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচাসার ব্যবহার করা যায়। বাড়ির আশপাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা স্তূপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ অর্থাৎ অক্টোবর নভেম্বর মাস আনারসের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তাছাড়া সেচের সুবিধা থাকলে মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফাল্গুন অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসেও চারা লাগানো যায়। এক মিটার প্রশস্ত বেডে দুই সারিতে চারা রোপণ করতে হবে। ৫০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে লাইনে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে চারা লাগাতে হবে।
চারা বেশি লম্বা হলে ৩০ সেন্টিমিটার পরিমাণ রেখে আগার পাতা সমান করে কেটে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে আনারস চাষের জন্য কন্টুর পদ্ধতি বা সমউচ্চতা বরাবর ঢালের বিপরীতে আড়াআড়িভাবে জোড়া সারি করে চারা রোপণ করা হয়। কখনও ঢাল বরাবর সারিতে চারা রোপণ করা উচিত নয়। এতে ভূমিক্ষয় বাড়ে।
পাহাড়ের ঢালে জোড়া সারিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ২০-২৫ সেন্টিমিটার দেয়া উচিত। এতে হেক্টরপ্রতি ৫০ হাজার বা কানিপ্রতি (৪০ শতাংশ) ৮ হাজার চারা প্রয়োজন। নির্ধারিত স্থানে চারা রোপণের পর গোড়া ভালোভাবে চেপে দেয়া উচিত। যদিও পাহাড়ি এলাকাতে দূরত্ব সঠিকভাবে মানেন না।
গাছপ্রতি পচা গোবর ৩০০ গ্রাম, ইউরিয়া ৩৫ গ্রাম, টিএসপি ১৫ গ্রাম, এমওপি ৩৫ গ্রাম ও জিপসাম ১৫ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে যত চারা আছে তা হিসাব করে সে মতো সার প্রয়োগ করতে হবে। গোবর, জিপসাম ও টিএসপি সার বেড তৈরির সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার চারা রোপণের ৪-৫ দিন পর থেকে শুরু করে ৫-৬ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। সার বেডে ছিটিয়ে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে আনারস একটি উল্লেখযোগ্য ফসল। সেখানে পাহাড়ের ঢালে কন্টুর পদ্ধতিতে সুন্দর লাইন করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আনারস লাগানো হয়। সার ব্যবস্থাপনাও সমতল ভূমির আনারসে চেয়ে ভিন্নতর। চারা রোপণের দুই মাস পর গাছপ্রতি ইউরিয়া ও টিএসপি সার ১০ গ্রাম করে গাছের গোড়া থেকে ১৫ সেন্টিমিটার দূরে ডিবলিং পদ্ধতিতে/পেগিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে। একইভাবে গাছের বয়স যখন ৭-৮ মাস হবে তখন আর একবার একই মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হয়।
শুকনো মৌসুমে আনারস ক্ষেতে সেচ দেয়া খুবই প্রয়োজন। বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেজন্য নালা কেটে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। চারা বেশি লম্বা হলে ৩০ সেন্টিমিটার পরিমাণ রেখে আগার পাতা সমান করে কেটে দিতে হবে। আগাছা আনারসের খুবই ক্ষতি করে। তাই আনারসের জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখা প্রয়োজন। বছরে অন্তত দুইবার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে; একবার আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ফল সংগ্রহ করার পর ও দ্বিতীয় বার অক্টোবর-নভেম্বর মাসে।
গাছ বড় হওয়ার আগে এটি সম্ভব। কিন্তু গাছ ঝোপালো হয়ে গেলে আগাছা পরিষ্কার করা যায় না তেমনি পরিষ্কার করার তেমন প্রয়োজনও পড়ে না। জমিতে সেচ এবং সার প্রয়োগের পর মালচিং করে নিলে জমি আগাছামুক্ত থাকে। আগাছা দিয়ে মালচিং করার পর একসময় পচে জৈবসার হিসেবে মাটিতে যুক্ত হয় এবং এতে করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়।
আনারসে সাধারণত বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। চাষের জমিতে পোকার আক্রমণ হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করলে বেশি ভালো হয়। তবে যে কোনো প্রয়োজনে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
আনারস চাষে অন্যান্য লাভের সাথে আরেকটি লাভ মুড়ি ফসল। মুড়িগাছ একাধিক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং ফল ধরে। সাধারণত মুড়ি ফসল থেকে ৫ থেকে ৬ বছর সফলভাবে ফল সংগ্রহ করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে আগাছা পরিষ্কার, শূন্যস্থান পূরণ, সার প্রয়োগ, বালাই ব্যবস্থাপনার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। আনারসের সাথে অনায়াসে আদা, সয়াবিন, সরিষা, কলাই, কচু সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন ফল গাছের বাগানের ভেতর আনারস আবাদ করে।
পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত ট্যারেসিং বা কন্টুর পদ্ধতিতে ৬০ সেন্টিমিটার গভীর ও ৩০ সেন্টিমিটার প্রস্থ চাষ করা ভালো। পাহাড়ি এলাকায় জমি তৈরিতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেন না বেশি নাড়াচাড়া করলে ভূমি ক্ষয় হয়ে যাবে।
সাধারণত চারা রোপণের ১৫-১৬ মাস পর মাঘ মাসের মাঝামাঝি থেকে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে আনারস গাছে ফুল আসে। কিছু কিছু জাত আছে সারা বছর আনারস দেয়।