মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবু আব্দুল্লাহ হেল কাফীর বিরুদ্ধে আজগুবি বিলে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটি ৭ মাসেও তদন্ত রিপোর্ট জমা দেননি। কেবলমাত্র অভিযোগকারীদের নোটিশ করে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে ডেকে এনে অভিযুক্ত চেয়ারম্যানের পক্ষে হামকি-ধামকি দিয়েই তদন্ত কর্মকর্তা নিরব হয়ে গেছেন। তার এই রহস্যজনক ভুমিকায় মহম্মদপুর উপজেলাবাসী হতবাক হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে যে, তবে কি সরকারী টাকা আত্মসাৎ এর কোন প্রতিকার চান না এই সরকারী কর্মকর্তা ? মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন তদন্তে উদাসীন তা কারো বোধগম্য নয়।
অভিযোগ অনুসন্ধানে জানাগেছে, মহম্মদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবু আব্দুল্লাহ হেল কাফী বিগত অর্থ বছরে মহম্মদপুর উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন খাতের অর্থ অতিরিক্ত ও ভুয়া বিল ভাউচারে
আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে স্থানীয় হাসানুজ্জামান সুমন, উলফাত মোল্যাসহ একাধিক ব্যক্তি স্বাক্ষরিত এক অভিযোগপত্র স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ প্রাপ্তির পর তদন্তের জন্য মাগুরা জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ।
অভিযোগপত্র সূত্রে জানা যায়, উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে প্রায় ১৩ একর জমির ওপর অবস্থিত কয়েক লাখ টাকার পুরোনো গাছ কেটে বিক্রি করে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন চেয়ারম্যান আবু আব্দুল্লাহ হেল কাফী। তিনি মহম্মদপুর আদর্শ টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ায় মাসিক বেতন ৩৮ হাজার ৪১১ টাকা এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সম্মানী ভাতা ৪৫ হাজার টাকাসহ অন্যান্য সুবিধা একত্রে ভোগ করছেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান প্রভাব খাটিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৯-২০ অর্থবছরে টেন্ডার করা ব্রিজ-কালভার্টের দরপত্রের শিডিউল বিক্রির ১৭ লাখ টাকা তৎকালীন ইউএনও মিজানুর রহমান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের যোগসাজশে ভাগ বাটোয়ারা করে আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া পরিষদ সংলগ্ন হেলিপ্যাডে সবজি চাষ দেখিয়ে ১৪ লাখ টাকা উপজেলা পরিষদের তহবিল থেকে উত্তোলন করেন। একই অর্থবছরে কোটেশনে উপজেলা পরিষদের ৩০ লাখ টাকার বেশি কাজ করার বিধান না থাকলেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইউএনওর সঙ্গে যোগসাজশে এক কোটি ১১ লাখ ৬৯ হাজার ২১২ টাকার কাজ টেন্ডার ছাড়াই এক্সপার্ট ইঞ্জিয়ারিং কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অবৈধভাবে তড়িঘড়ি করে সম্পন্ন করেছেন। বাসাবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কাজ একই কোম্পানি দিয়ে নামমাত্র করিয়ে ২০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। তার নামে মাগুরার বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২৭ লাখ টাকার চেক জালিয়াতির একটি মামলা বিচারাধীন। দরপত্র আহ্বান না করে তিনি কোটেশনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ করেছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে টিআর, কাবিটা, কাবিখা ও এডিপির প্রকল্প বাস্তবায়নে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। তিনি মহামারি করোনার শুরুতে জনগণের পাশে না থেকে বিনা ছুটিতে চার মাসের বেশি সময় ঢাকায় অবস্থান করেছেন।
২০২০-২১ অর্থবছরে রাসেল নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে কোনো প্রকার কাজকর্ম ছাড়াই মনগড়া বিল-ভাউচার তৈরি করে অপ্রত্যাশিত খাতে পাঁচ লাখ, অফিস সরঞ্জামে তিন লাখ, আসবাবপত্র মেরামতে ৫০ হাজার, পানির পাম্প মেরামতে ৫০ হাজার, বর্জ্য অপসারণে এক লাখ, নবগঙ্গা বাসা মেরামতে ১০ লাখ টাকা তহবিল থেকে তোলা হয়েছে। আবার একই কাজে একাধিক বিল-ভাউচার করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তিনি স্থানীয় ঠিকাদার কানু তেওয়ারী, চেয়ারম্যানের সিএ জাকির হোসেন, ইউএনওর অফিস সহকারী বিধান সাহাসহ অফিসের পিয়ন ও নৈশপ্রহরীর নামে একাধিক বিল-ভাউচারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। যাদের নামে এসব বিল-ভাউচার করা হয় তাদের মোটা অঙ্কের কমিশন দেওয়া হয়েছে। ব্যয়িত বিল-ভাউচার নীরিক্ষা করে জানা যায়, ঠিকাদার কানু তেওয়ারীর মাধ্যমে তহবিল থেকে ২০ লাখ টাকার বেশি উত্তোলন করা হয়েছে।
ঠিকাদার কানু তেওয়ারী বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। উপজেলা চেয়ারম্যানের সিএ জাকির হোসেন ও ইউএনওর অফিস সহকারী বিধান সাহা সব বিষয় অস্বীকার করেন।
কিছু ক্ষেত্রে ভাউচারে বিস্ময়কর বিল করা হয়েছে। যেমন, ম্যুরালের সামনে মই দিয়ে মাটি সমান করতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ হাজার টাকা, তিনটি গাছ কাটতে দেখানো হয়েছে ২৫ হাজার ৭৫০ টাকা, ব্যাডমিন্টন কোর্ট পরিস্কার করতে ১২ হাজার ৩০০ টাকা, কোদাল, দা, সোল ও টেংগি ক্রয় আট হাজার টাকা, একজন অতিথির এক বেলার নাশতা তিন হাজার টাকা, মৎস্য অফিসের অবৈধ কারেন্ট জাল পোড়ানো খরচ ১৫ হাজার ৭০০ টাকা, পানির ট্যাঙ্ক পরিস্কার ১১ হাজার ৫২০ টাকা, লাইব্রেরির মালপত্র স্থানান্তর ৯ হাজার টাকা, ২২টি গাছের গোড়া রং করা দুই লাখ টাকা, ইমরুলের খাবার পাঁচ হাজার ৮০০ টাকা। কিন্তু কে এই ইমরুল তার তথ্য ও পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে দোকানঘর নির্মাণ করে দেওয়ার কথা বলে শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ লাখ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ প্রাপ্তির পর গত ১২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত একটি পরিপত্রে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব বিষয়টি তদন্তের জন্য মাগুরা জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দেন।
২০১৯-২০ অর্থবছরে টেন্ডার করা ব্রিজ-কালভার্টের দরপত্রের তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের দাবি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমার দপ্তরে ব্রিজ-কালভার্টের কোনো টেন্ডার হয়নি। সেটা হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। কিন্তু মূল বিষয় এড়িয়ে যান তিনি। উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যান বেবি নাজনীন (প্যানেল চেয়ারম্যান) বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানের অনিয়মতান্ত্রিক কাজকর্মে বাধা দিলেও তিনি কথা শোনেননি। উপায় না পেয়ে পরে আমি দুদকসহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাগুরা জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম বলেন, তদন্তের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে নির্দেশনা পেয়েছি। শিগগিরই তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মমতাজ বেগম বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তের জন্য মাগুরা জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আব্দুল্লাহ হেল কাফী সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে, তিনি মুঠো ফোন ধরেননি।