খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গায় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরাদ্দকৃত দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নির্মাণকাজ চলাকালীন সময়ে পিআইও এর মনোনীত মিস্ত্রি ছাড়া কোন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধি সরেজমিনে পরিদর্শনে যাননি অভিযোগ সুবিধাভোগীর। প্রতিটি ইউনিয়নে নির্মাণ কাজের জন্য নির্ধারিত তদারকি কর্মকর্তা থাকলেও সরেজমিনে সুবিধাভোগীরা তাদের উপস্থিতি দেখতে পাননি বলে জানান তারা।
সরেজমিনে গেলে সুবিধাভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী সৈয়দ আলী এবং তার ছেলে মো: আবদুল মান্নান- প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থবছর শেষ হয়ে দু বছর পার হলেও পুর্ণাঙ্গ নির্মাণকৃত ঘর এখনো বুঝে পায়নি বলে জানান। এরই মধ্যে নির্মানাধীন ভবনের বিভিন্ন অংশে দেখা দিয়েছে ফাটল, বেড়েছে ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকি। তারা জানান, নির্মাণের কাঁচামাল সিমেন্ট ও বালির মিশ্রণে মানা হয়নি সরকারি নির্দেশনা। টিনের ছাউনিতে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের কাঠ। জানালায় দেয়নি গ্রীল, দরজার ফ্রেম উইপোকায় খেয়ে ফোকলা করে ফেলেছে। টয়লেট ও রান্নাঘর অর্ধনির্মান অবস্থায় পড়ে আছে।
এছাড়াও তবলছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কাদের এর নির্দেশে নির্মাণ কাজের মালামাল পরিবহন খরচ, ঘরে ব্যবহৃত কাঠ ক্রয়, দরজা জানালার কবজা, সিটকারি, পেরাগ ও শ্রমিকের খাবার খরচ সহ প্রায় ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে বলে জানান সৈয়দ আলী।
তবলছড়ি ২নং ওয়ার্ডের শুকনাছড়ি ইসলামপুর এলাকার সুবিধাভোগী কমলা বেগম জানান, চেয়ারম্যান আবদুল কাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ক শ্রেণির ঘর দেয়ার কথা বলে স্থানীয় ইউপি সদস্য মো: তাজুল ইসলাম এর মাধ্যমে ২৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। তার নামে বরাদ্ধকৃত নির্মানাধীন ঘরে লাগানো লোহার জানালার পাল্লা, ঘর বুুঝিয়ে দেয়ার আগেই ভেঙ্গে গেছে। পিছনের দরজা দেয়া হয়নি এবং সামনের দরজার অবস্থা এখনি নড়বড়ে। বরাদ্ধের চেয়েও কম পরিমাণ সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। শ্রমিকদের খাবার খরচ বাবদে আরো খরচ করতে হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা।
অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্ধকৃত প্রথম দফার ঘরগুলোর মধ্যে তবলছড়ি ইউনিয়নের সরকার পাড়া এলাকার শাহজালাল হোসেন (বাবু) এর নামীয় ঘরটি অর্ধনির্মিত অবস্থায় রয়েছে। সরেজমিনে গেলে তিনি জানান, নির্মাণের পরপরই বারান্দার পিলার ভেঙ্গে পড়ে গেছে । চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি কোন ব্যবস্থা নেননি । জানালার গ্রীল, টয়লেটের টাংকি, রান্না ঘরের দেয়াল, পিছনের প্যাসেজ ও ফ্লোর, ২ ফুট উচু ভিটেও করা হয়নি। নিজের টাকা ব্যয় করে কিনতে হয়েছে টিনের ছাউনিতে ব্যবহৃত কাঠ সহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী । শ্রমিকদের খাবারের খরচ সহ শাহজালাল হোসেন (বাবু)র খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। যা সেই কৌশলী মহাজন প্রথার মতো শ্রম ও ঘামে অর্জিত দরিদ্রের টাকা কেড়ে নেয়ার ঘটনা।
এছাড়াও একই ইউনিয়নে টিআর কর্মসূচির আওতায় দূর্যোগ সহনীয় বাসগৃহের সুবিধাভোগী গৌরাঙ্গ পাড়া এলাকার মনমোহনী শীল জানান, আমার ঘরের কাজ অর্ধনির্মাণ অবস্থায় পড়ে ছিল প্রায় ছয় মাসেরও অধিক সময়। পরে উপায়ন্ত না পেয়ে নিজের নামে ঋন নিয়ে টয়লেট, রান্নাঘর, জানালার গ্রীল, ঘরে ব্যবহৃত কাঠ, পিছনের প্যাসেজ লম্বা ৮ ফুট পার্শে ৬ ফুট ভিটে পাকাকরণ, সামনের বারান্দা, রং করণ, ফ্লোর পাকাকরণ, মুল ভবনের ২ফুট উচু পাকা ভিটা নির্মান কাজ করতে হয়েছে সুবিধাভোগী এই ব্যক্তিনীকে। এতে মনমোহনী শীল এর খরচ হয়েছে প্রায় (৮৩,৫০০) তিরাশি হাজার পাঁচশত টাকা। যা ছিল দরিদ্র এই ব্যক্তিনীর পক্ষে অত্যান্ত কষ্টসাধ্য।
একই ওয়ার্ডের সুবিধাভোগী মোঃ আবু তাহের বলেন, তার নামে বরাদ্দকৃত ঘরের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ঘর নির্মানে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের ইট, সিমেন্ট ও বালু। নেই জানালার গ্রীল, রান্নাঘর, টয়লেট ও টাংকি। নিজের অর্থ ব্যয় করে ঘর নির্মানের জন্য তীর, পাইর, দরজা জানালার সিটকারী, ঘরে ব্যবহৃত কাঠ কিনতে হয়েছে তাকে। প্রতিদিন নিজের তহবিল থেকে ০১ জন নির্মাণ শ্রমিকের বেতন ৫০০ টাকা চালাতে নির্দেশ দেন চেয়ারম্যানের নিয়োগকৃত মিস্ত্রি আমির হোসেন। এতে সুবিধাভোগী আবু তাহের এর খরচ করতে হয়েছে ৩৯,০০০ (ঊনচল্লিশ) হাজার টাকা।
এ বিষয়ে তবলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দূর্যোগ সহনীয় বাসগৃহের যে ঘর বরাদ্ধ হয়েছিল সেগুলোর কাজ প্রথমে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ( পিআইও) রাজ কুমার শীল , নির্মাণ সামগ্রী চট্টগ্রাম থেকে এনেছেন এবং তার পছন্দের নিয়োগকৃত মিস্ত্রি জনৈক আমির হোসেন এর মাধ্যমে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে পিআইও কাজের অর্ধেক সম্পাদন করা অবস্থায় আমাকে দায়িত্বভার দেন। প্রথমে আমি এই দায়িত্ব নিতে না চাইলে, ভবিষ্যতে তবলছড়ি ইউনিয়নে কোন ঘর দেয়া হবে না শর্ত দিলে আমি অবশিষ্ট নির্মানকাজ সম্পাদন করে দিতে রাজি হই এবং বাকী কাজ সম্পন্ন করি। বিল যদিও আমার স্বাক্ষরে হয়েছে কিন্তু টাকা উত্তোলন হয়েছে পিআইও রাজকুমার শীল এর পরিকল্পনায়। বিল করার পুর্বে আমার কাছ থেকে তিনি অগ্রিম চেক নিয়েছেন পরে সরকারি কাজের বিপরীতে দেয়া বিল তিনি আমার চেক দিয়ে তুলেছেন। বিভিন্ন সুবিধাভোগীর কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি তিনি উড়িয়ে দিয়ে বলেন তবলছড়ি ইউনিয়ন এলাকায় কতগুলো ঘর নির্মানের কাজ হয়েছে তার সংখ্যা তিনি নিজেও জানেন না।
বিষয়টি সম্পর্কে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রাজকুমার শীল বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নির্মাণকৃত দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহগুলো বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি জানেন না দাবী করে তিনি বলেন যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অর্থ লেনদেনের সাথে জড়িতরাই দ্বায়ভার গ্রহন করবেন । পিআইও হয়ে নিজেই ঠিকাদারী করতে পারেন কিনা ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি কোন কাজ করাইনি, আমি তো ঠিকাদার নই । মাটিরাঙ্গার সকল ঘর নির্মাণ কাজই সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি চেয়ারম্যানরাই সম্পাদন করেছেন।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ হেদায়েতুল্লাহ বলেন, আমি এখানকার দায়িত্বভার নিয়েছি আজকে ৪র্থ কার্যদিবস চলছে । এরমধ্যে আমি শুনেছি এ ধরনের বিষয়। আমি নিজেও কয়েকটি জায়গায় গিয়েছি। এখনো ঘরের কাজ চলমান আছে । আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর মাটিরাঙ্গা উপজেলাতেও এসেছে ,কিন্তু কোন ইউনিয়নে জন্য কতগুলো ঘর এসেছে এই বিষয়ে আমাকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার অথবা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কিছুই জানায়নি। তারা তাদের মতো করে ঘর করছে যা আমাকে অবগত করা হয়নি। ইতিমধ্যে গণমাধ্যম কর্মীদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে। গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারের মাঝে বিতরণের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এমন কোনো কাজ হয়ে থাকলে তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করার আশ্বাস দেন তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম হুমায়ুন মোর্শেদ খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের ন্যায় মাটিরাঙ্গাতেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বির্ণিমানের অন্যতম একটা ধাপ হিসেবে এটার সুফল মাটিরাঙ্গার জনগন পাবে। কিন্তু আমরা বিভিন্নভাবে তথ্য পাচ্ছি নেতাকর্মীদের মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে যারা জড়িত তারা এখানে বিভিন্ন রকম অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে। সুতরাং আমাদের সু-স্পষ্ট বক্তব্য দলীয়ভাবে এবং সকল নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে বলতে চাই- তদন্ত সাপেক্ষে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক। মাটিরাঙ্গা উপজেলায় এই পর্যন্ত কোন ইউনিয়নে কতগুলো ঘর বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে? কতগুলো ঘরের কাজ সম্পন্ন হয়েছে তা দলীয়ভাবে উপজেলা আওয়ামী লীগের কাছে কোন তথ্য নেই। তিনি তথ্য গোপনের অভিযোগ করে বলেছেন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছি, কি পরিমাণ ঘর বরাদ্ধ এসেছে ? এবং কারা পাচ্ছে ? কারা এ সব তালিকা প্রনয়ন করছে? বা কতগুলো ঘর নির্মাণ হয়েছে ? কতগুলি নির্মানাধীন রয়েছে এটা আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। বরাদ্ধকৃত ঘরের তালিকা পিআইও এবং ইউএনও এর কাছে চেয়েও আমরা পাইনি বলতে গেলে ব্যর্থ হয়েছি। এ সময় অনিয়ম ও দুর্নীতি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহৎ উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ ছাড়াও প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত দোষী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
প্রসঙ্গত : আশ্রয়ণের অধিকার – শেখ হাসিনার উপহার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উপহার বাসগৃহ বিতরণে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।