সম্প্রতি ঢাকায় কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। মূলত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব কিশোর নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টেছে। যার দরুন অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই জেনারেশন দেশকে আসলে কোথায় নেবে?
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-এর তথ্যমতে, রাজধানীতে ৫২টি সক্রিয় ‘কিশোর গ্যাং’-এর নাম আছে। প্রতীকী ছবি
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-এর তথ্যমতে, রাজধানীতে ৫২টি সক্রিয় ‘কিশোর গ্যাং’-এর নাম আছে। প্রতীকী ছবি
আবু সাঈদ নিশান
এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনোখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ এই বয়সে তাদের মাঠে খেলাধুলা করার কথা। নতুন নতুন উদ্ভাবনী কাজে অংশগ্রহণ করার কথা।
বৃহস্পতিবারের (১২ অক্টোবর) ঘটনাটা দেখলেই বুঝা যায় কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য কতটা বেড়েছে। রাজধানীর দক্ষিণখানের কসাইবাড়ি এলাকায় পাওনা ২ হাজার টাকা নিয়ে সিফাত নামে এক কিশোরকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে কিশোর গ্যাং। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
এমন অসংখ্য ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে। এই তো কয়েকদিন আগেই রাজধানীর মোহাম্মদপুরে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষের হাত বিচ্ছিন্ন করে টিকটক করার মতো লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সময় তারা ৪০ থেকে ৫০ জন একসঙ্গে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে ছিনতাই ও সন্ত্রাস চালায়। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান ও বসিলাসহ বিভিন্ন জায়গায় সংঘবদ্ধভাবে তারা এসব ঘটনা ঘটায়।
এর আগে গত ২২ মে রাজধানীর দারুসসালাম থানার লালকুঠি এলাকার বসুপাড়ায় স্কুলছাত্র সিয়াম খানকে (১৪) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তার আগে ১০ মে দনিয়া কলেজের সামনে ‘জুনিয়র-সিনিয়র’ দ্বন্দ্বে খুন হয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তাজুন ইসলাম ওরফে মুশফিক। দুটি হত্যাকাণ্ডের পেছনেও রয়েছে এলাকাভিত্তিক অপরাধী চক্রের তৎপরতা। এসব চক্র স্থানীয়ভাবে ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত। যাদের বড় অংশ কিশোর হলেও নেতাদের বয়স ১৯ থেকে ৩৮ বছর। তাদের ‘সিনিয়র’ বা ‘বড় ভাই’ বলে ডাকে চক্রের সদস্যরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব চক্রের নেতাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত অথবা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকে।
কিশোর গ্যাং যেভাবে আলোচনায় আসেঃ–
রাজধানীর উত্তরায় ২০১৭ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের নির্মমতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। ওই বছরের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের খেলার মাঠে তাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর র্যাব অভিযান চালিয়ে দুটি চক্রের প্রধানসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে।
ডিএমপির তালিকা অনুযায়ী, উত্তরায় এমন ছয়টি চক্র রয়েছে; যার সদস্য ৬৪ জনের মতো। ‘ইয়াং স্টার’, ‘ডিসকো বয়েজ’, ‘বিগবস’ ইত্যাদি নামে সক্রিয় এসব চক্রের সদস্যরা পার্টি করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো এবং রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে থাকে। এসব করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ছিনতাইসহ নানান অপরাধেও অনেকে জড়িত।
ডিএমপির উত্তরা অপরাধ বিভাগের তথ্য অনুসারে, তুরাগ থানা এলাকায় ‘পারভেজ গ্রুপ’, উত্তরখানে ‘রুস্তম গ্রুপ’ ও ‘নাইন এমএম বিগ বস’, দক্ষিণখানে ‘বিগবস’ ও ‘ইয়াং স্টার গ্রুপ’, উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় ‘নাইন স্টার গ্রুপ’ নামে অপরাধী চক্র রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনোখুনিতে কিশোর ও তরুণদের ব্যবহার করার ঘটনাও ঘটেছে।
সবচেয়ে বেশি ‘কিশোর গ্যাং’ মিরপুরেঃ–
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-এর সক্রিয় ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ তালিকায় রাজধানীতে এখন পর্যন্ত ৫২টি চক্রের নাম এসেছে। আটটি অপরাধ বিভাগের অধীন ৩৩ থানা এলাকায় এসব চক্রের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৬৮২।
ডিএমপি সূত্র বলছে, রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ‘কিশোর গ্যাং’ মিরপুর বিভাগে। এই বিভাগে ১৩টি কিশোর অপরাধী চক্রের ১৭২ সদস্য সক্রিয় বলে পুলিশের তালিকায় উল্লেখ রয়েছে।
এর মধ্যে মিরপুরের দারুস সালাম থানার লালকুঠি এলাকায় রয়েছে দুটি চক্র। একটি ‘অতুল গ্রুপ’, অপরটি ‘পটেটো রুবেল গ্রুপ’ নামে পরিচিত। এর মধ্যে অতুল গ্রুপের সদস্য ২০ থেকে ২৫ জন। চক্রটির প্রধান শফিকুর রহমান ওরফে অতুল।
কিশোর গ্যাং কেন তৈরি হচ্ছে ?
পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবেই মূলত কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। আর একবার কিশোর গ্যাং তৈরি হয়ে পড়লে তখন আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতা প্রদর্শনের অংশ থেকেই এর ডালপালা বাড়তে থাকে। একটা সময় রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের সুবিধার্থে এসব গ্যাংকে ব্যবহার করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে বয়সে আমাদের সন্তানদের পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা, সে বয়সে তাদের এমন অপরাধে জড়ানোর কারণ কী হতে পারে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, সন্তানকে যথেষ্ট সময় না দেয়া, সামাজিক অবক্ষয়, স্বল্প বয়সে স্মার্টফোনে আশক্তিসহ উন্নত প্রযুক্তি উপকরণের নাগাল পাওয়া, সঙ্গদোষ, যৌক্তিকতা বিচার না করেই সব আবদার পূরণ করা এবং সন্তান কী করছে সে বিষয় পর্যবেক্ষণের অভাব ইত্যাদি নানাবিধ কারণে কিশোরদের অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মায় না ঠিক, কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে তারা ক্রমেই অপরাধী হয়ে উঠছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যথাযথ শিক্ষার অভাবে দিন দিন কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বাড়ছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শুধু এ প্লাসের কথাই বলছে। কেউ খেলাধুলা, মূল্যবোধের শিক্ষার কথা বলছে না। তারা মূল্যবোধের শিক্ষা, সংস্কৃতির শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খেলার মাঠের সংকটে তারা খেলতে না পেরে মোবাইলে সময় দিচ্ছে। যার ফলে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার অবাধ ব্যবহারে বাড়তি রসদ জুগিয়েছে গ্রুপের বিস্তারে।
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমাদের দেশে শিশুদের লালনপালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্বপালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায় এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রশমিত না হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোর অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং:
কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িতরা পর্যায়ক্রমে আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে। তাদের ড্রেস কোড থাকে, আলাদা হেয়ার স্টাইল থাকে, চালচলনও ভিন্ন। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও অর্থ সংস্থানের চেষ্টা করে। এলাকার কোনো ‘বড় ভাই’র সহযোগী শক্তি হিসেবেও তারা কাজ করে। দেখা যায়, এই বড় ভাইয়েরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। তারাই এই কিশোর গ্যাংদের নানাভাবে অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করছে।
এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী রাশেদা ইরশাদ বলেন, কিশোরদের একত্রিত করে কতিপয় ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত করছেন। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। সহজ ও অল্প খরচে কিশোরদের দিয়ে তারা অপরাধ করানোর সুযোগ নিচ্ছে। অস্ত্রবাজি, মাদক ও হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা কিশোরদের ব্যবহার করে। এছাড়া কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছেন।
তিনি বলেন, এই কিশোর গ্যাং দিন দিন এতো ভয়াবহ হয়ে উঠছে যে, ছিনতাই করেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না; হত্যা করে ফেলছে, ধর্ষণ করে খুন করে ফেলছে। তারা এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজনে স্থানীয় নেতা বা প্রভাবশালী বড়ভাইদের ছত্রছায়ায় গড়ে তুলছে এসব কিশোর গ্যাং কালচার। কাউকে গালি দিলে বা সিনিয়রদের জুনিয়ররা যথাযথ সম্মান না দেখালে মারামারির ঘটনা ঘটছে। শক্তিমত্তা প্রদর্শনের প্রয়োজনে অস্ত্র বহন ও ফাঁকা ফায়ারিং করে এবং গ্রুপ করে মোটরসাইকেল নিয়ে দেয়া হচ্ছে মহড়া।
রাশেদা ইরশাদ বলেন, এভাবে আস্তে আস্তে গ্রুপের মধ্যে ঢুকে পড়ে মাদক। এর প্রভাবে এদের মধ্যে লোভ তখন বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে এই গ্যাংটাকে কাজে লাগিয়ে প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় টাকা আদায়ের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়, আর মাদকের খরচ চালাতে হলে ছিনতাই থেকে শুরু করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এই গ্যাং।
মূলত মাদক ও অস্ত্রের সহজলভ্যতা এবং সমাজ-পরিবারের যথেষ্ট মনোযোগের অভাবে কিশোর সমাজ এই গ্যাং কালচারে জড়িত হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানী রাশেদা ইরশাদ।
পুলিশ কী বলছে:–
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মহিদ উদ্দিন বলেন, এসব অপরাধী চক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেকেই থাকে বস্তিতে। তবে সঙ্গদোষে অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা কমাতে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা- সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। কিশোর-তরুণেরা যাতে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনে বলেন, কোনো এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়লে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণেও অনেক এলাকায় কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা থাকে। সেটা নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে বেগ পেতে হয়। এ পর্যন্ত ৪৬ মামলায় ২৩৬ জন কিশোর অপরাধী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সারা দেশেই কিশোরদের গ্যাং সংস্কৃতি এবং অপরাধ বন্ধে কাজ করতে পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান মহিদ উদ্দিন।
শুধু পুলিশ নয়, স্কুল-কলেজ, অভিভাবক এবং সুশীল সমাজের সমন্বয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রম বন্ধে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি।