আব্দুল মান্নান, স্টাফ রিপোর্টার (খাগড়াছড়ি)
কাজুবাদামে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন- সি, প্রোটিন, ফ্যাট, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন বি-১ এবং সেই সঙ্গে ওষধি গুণাগুণ থাকায় বিশ্ববাজারে কাজুবাদামের দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। কাজুবাদাম একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফসল, যার চাষাবাদ এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পুষ্টিকর এই কৃষিপণ্যটির জন্য মূলত এই দুই মহাদেশের উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। ফলে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে সম্প্রতিকালে কাজুবাদাম ও কফি চাষ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলায় গত তিন অর্থবছরে ২৮.৬৭ হেক্টর জমিতে সৃজিত হয়েছে কাজুবাদাম। প্রথম পর্যায়ে সৃজিত বাগানগুলোতে ফুল আসা শুরু করেছে এবং কাংখিত ফলনের স্বপ্ন বুনছেন এখানকার চাষিরা। এক কেজি প্রক্রিয়াজাত করা (প্যাকেটকৃত) বাদামের মূল্য প্রায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। সাধারণ কৃষকেরা প্রক্রিয়াজাত করতে না পারলেও শুধু বাদাম বিক্রি করে টনপ্রতি প্রায় ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব!
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র ও সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কৃষি বিভাগের “কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের” আওতায় খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলায় গত ২০২০- ২০২১ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত ২৮.৬৭ হেক্টর টিলা ভূমিতে কাজুবাদাম ও কফি বাগান সৃজিত হয়েছে। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে ১ হেক্টর জমির প্রায় ৪০০ টি কাজুবাদাম গাছে ফল প্রত্যাশি চাষি! গত বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলার লেমুয়া সালমা আক্তারের কাজুবাদাম বাগানে গিয়ে দেখা গেছে, ৫০ শতক জায়গায় এম-২৩ জাতের ৮০টি কাজুবাদাম গাছে চলতি মাসে ফুল আসবে, ইতোমধ্যে কিছু গাছে ফুল এসেছে। এতে ফল প্রত্যাশি চাষি বাগান পরিচর্যায় ব্যতিব্যস্ত। উক্ত ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অমুল্য কুমার দাশ বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত শ্রমিকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। এ সময় অমুল্য কুমার দাশ আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ এবং সেই সঙ্গে ওষধি গুণাগুণ সমৃদ্ধ কাজুবাদাম এই এলাকার জন্য নতুন একটি ফসল। ফলে চাষিরা এই লাভজনক ফসল চাষাবাদে এখনও পরিপক্ব হয়ে উঠেনি। নিয়মিত কাজুবাদাম চাষিকে পরামর্শ দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান করতে ও কৃষি বিভাগের উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি।
উপজেলা কৃষি অফিসার মো. কামরুল হাসান বলেন, কফি ও কাজুবাদাম চাষের জন্য পার্বত্য এলাকা অত্যন্ত উপযোগী। উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে মানিকছড়িতে কফি ও কাজুবাদাম চাষ এগিয়ে নেয়ার জন্য আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এর উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকেরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হবে, তেমনি দেশীয় চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। তিনি আরও জানান, তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির মোট আয়তন ১৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪০০ হেক্টর, যার মাত্র ৫ শতাংশ সমতল ফসলি জমি এবং বাকিটা পাহাড়ি এলাকা। কাজুবাদাম চাষের জন্য যে রকম মাটি, তাপমাত্রা ও বৃষ্টি দরকার তার সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই পাহাড়ি এলাকায়। তিন পার্বত্য জেলার কমপক্ষে ২২ শতাংশ জমিতে এখনি কাজুবাদাম চাষের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মাটিও কাজুবাদাম চাষের অনুকূলে। অর্থাৎ সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে ভিয়েতনামের সফলতার গল্প শুনতে হবে না; বরং বাংলাদেশ আগামী দিনে ভিয়েতনামের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় অপ্রচলিত ফসলের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক ২১১ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দেশে কাজুবাদামের প্রক্রিয়াজাত সহজতর করা এবং প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলার জন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির ওপর শুল্কহার ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে মাত্র ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে গ্রিন গ্রেইন গ্রুপ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় আধুনিক মানের একটি কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলে। বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস কাজুবাদাম প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনে চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১৫ একর জমি লিজের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। খাগড়াছড়িতেও প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠেবে। এতে চাষিরা তাঁদের উৎপাদিত কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে বাজারজাত করে বেশ লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে।