সমাজে ধনী হওয়ার, ধনী সৃষ্টির একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তারাই ক্ষমতাবান। তারাই দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা। রাষ্ট্রেরও নিয়ন্তা। সমাজে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট হচ্ছে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই। গ্রামের মানুষ এখন ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বড় গ্রাহক। প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই। স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। শুধু শহর-নগরই নয়, গ্রামগুলোও এখন বদলে গেছে। একসময় অজপাড়া গাঁ বলতে যা বোঝাত, তা এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রত্যন্ত, দুর্গম এলাকার গ্রামও এখন পাকা সড়ক দিয়ে সংযুক্ত হয়েছে শহরের সঙ্গে। আগে যেখানে হাঁটা কিংবা নৌকা ছাড়া যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না, এখন সেখানে যন্ত্রচালিত বাহনে চড়ে সহজেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া যায়। যে গ্রামে প্রয়োজনীয় তেলের অভাবে সব ঘরে কুপি-লণ্ঠনও জ্বলত না, এখন সেখানে হয় পল্লী বিদ্যুৎ নয় তো সৌর বিদ্যুতের আলো ঝলমল করে। যে গ্রামে ডাকে চিঠি, টেলিগ্রাম, মানিঅর্ডার পৌঁছাতে অনেক দিন লেগে যেত, সেই গ্রামেও আছে এখন মোবাইল ফোনের বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে মুহূর্তেই প্রিয়জনের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার সুযোগ। গ্রামে এখন ঘরে ঘরে টিভি। রয়েছে ডিশ লাইনের সংযোগ। এখন বেশির ভাগ গ্রামীণ সড়কই পিচঢালা। কাঁচা বা মাটির ঘর তেমন চোখে পড়ে না। অধিকাংশ বাড়ি পাকা ও আধাপাকা।
প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই। গ্রামের মানুষ এখন ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বড় গ্রাহক। কিশোর-কিশোরীদের একটা বড় অংশ এখন নিয়মিত ফেসবুক ও ইউটিউব ব্যবহার করে। ফেসবুকে নিজের মতামত লিখে চমকে দেয়। বিদেশে থাকা স্বজনদের সঙ্গে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারে কথা বলে।
গ্রাম মানেই এখন আর কৃষি কাজ নয়। গ্রামীণ জনগণের মধ্যে এখন কৃষির পাশাপাশি ছোট ছোট শিল্প স্থাপনের প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে। পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি গ্রামেই হাঁস-মুরগির খামার, দুগ্ধ উত্পাদনকারী ডেইরি ফার্ম, মৎস্য চাষ প্রকল্প চালু হয়েছে। এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ। স্বল্প সুদে মিলছে ঋণ। এখন পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বিভিন্ন কাজ করছেন। এতে পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। প্রত্যন্ত গ্রামের একটি মুদি দোকানে গেলেই এখন পরিবর্তনটা চোখে পড়ে। সেখানে শুধু চাল, ডাল আর কেরোসিন তেলই নয়, বিক্রি হয় শ্যাম্পু, সুগন্ধি সাবানসহ প্রসাধন সামগ্রীও। গ্রামের মানুষ এখন আর আম ডাল বা কাঠ-কয়লা দিয়ে দাঁত মাজে না, টুথপেস্ট ব্রাশ দিয়ে কিংবা নিদেনপক্ষে টুথ পাউডার ব্যবহার করে। চিপস, কোল্ড ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস, ফ্রুট ড্রিংকস౼এমনকি মিনারেল ওয়াটারও পাওয়া যায় গ্রামের বাজারে। বিভিন্ন বাড়িতে রয়েছে মোটরসাইকেল। অনেক গ্রামে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজে যায়। মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আমাদের অগ্রগতি চমকপ্রদ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মিয়ানমারের চেয়ে অনেক সূচকেই এগিয়ে বাংলাদেশ।
বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নয়ন হয়েছে এবং একইসঙ্গে সমাজের মৌলিক কাঠামোতে বিভিন্ন পরিবর্তন হয়েছে। নগদ টাকার ব্যবহার কমে যাচ্ছে। মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং জনপ্রিয় হচ্ছে। বাড়ছে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার। মানুষের পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারও বাড়ছে।
কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোতে সত্যিকারের পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে? পুষ্টি, নারী ও শিশুর সুরক্ষা, মানসম্মত শিক্ষা, সুশাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু এগোলাম? বেকারত্ব, বৈষম্য, বঞ্চনা কী কমছে? দেশের দুর্বলতর শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠা কী সম্ভব হয়েছে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের সকলেরই জানা। আর এটাই আমাদের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক দিক। এ কথা ঠিক যে, আর্থিক ও উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আমরা অনেক দিক থেকেই এগিয়েছি। কিন্তু আরও যেসব ক্ষেত্রে যেভাবে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, আমরা সেখানে সেভাবে অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। যদিও অগ্রগতির কোনো অন্ত হয় না। অগ্রগতি বহাল রাখতে চাইলেই রাখা যায়। বহাল রাখাটা জরুরিও। দেশের বা নাগরিকের অগ্রগতি বলতে সাধারণভাবে যা বোঝানো হয়, শুধু সেই বস্তুগত অগ্রগতি হলেই কিন্তু চলে না। মূল্যবোধ, চিন্তাধারারও অগ্রগতি জরুরি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। সেটা করতে আমরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছি।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়নি। প্রতিটি নাগরিকের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো যাতে পূরণ হয়, সেই ব্যবস্থা এখনও করা যায়নি।
বায়ান্ন বছর আগে আমরা পাকিস্তনি দুঃশাসন থেকে মুক্ত হয়েছিলাম। আজ কিন্তু অন্য অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয়। সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার অভাব, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ—এই রকম একের পর এক সামাজিক বিষ আজ আমাদের গিলে খেতে চাইছে।
বর্তমানে রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিসর অদ্ভুতভাবে পাল্টে যাচ্ছে! যারা শক্তিশালী, ক্ষমতাবান তারাই ঠিক করে দিচ্ছে মানুষের আচার-আচরণ কী হবে! জীবনের সব ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী এই ধারাই বিকশিত হয়ে উঠছে।
বর্তমানে লক্ষ লক্ষ মানুষ লেখাপড়া, জীবিকা, চিকিৎসা কিংবা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বাইরের দেশে যাচ্ছে। উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু এর পাশাপাশি অন্ধবিশ্বাস, গুজব, আইন লঙ্ঘনের প্রবণতাও সমান তালে বাড়ছে। ‘ডার্ক সাইড অব দ্য মুন’-এর মতো আমরা ক্রমেই ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
সবচেয়ে বড় কথা মানুষ কেমন আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে উঠছে। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজবদ্ধ মানুষের ধারণা যেন অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। প্রত্যেক মানুষ একে অপরের কল্যাণের কথা ভেবে সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিয়ম ও শৃঙ্খলার অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাস করলে সেই জনগোষ্ঠীকে সমাজ বলে। এই সমাজকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিমানুষের অন্যতম দায়বদ্ধতা। এক সমাজে ধনী, গরিব, সহায়-সম্বলহীন নানা রকম মানুষের বাস। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাইকে নিয়েই সমাজ। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়াই হলো সমাজসেবা। কিন্তু কেমন আছেন পাশের বাড়ির মানুষটি? এমন প্রশ্ন করার মতো সময়ও আমাদের নেই। ক্রমেই আমরা নিজের বাঁচছি, নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকছি।
সমাজে ধনী হওয়ার, ধনী সৃষ্টির একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তারাই ক্ষমতাবান। তারাই দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা। রাষ্ট্রেরও নিয়ন্তা। সমাজে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট হচ্ছে। একটি গরিব লোক শিক্ষিত, মেধাবী ও নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা রাখলেও বর্তমান সমাজব্যবস্থায় তাকে সুযোগ না দিয়ে অবমূল্যায়ন করে পেছনে ফেলে রাখা হচ্ছে। যা আমাদের জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। পক্ষান্তরে নানা ফিকিরে বড়লোক বনে যাওয়া একজন ব্যক্তি মেধা ও নেতৃত্বের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সমাজে নেতা হয়ে বসছে। এটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই সমাজ নিয়ে আমাদেরই ভাবতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে সমাজ নিয়ে। প্রকৃত সুখ রয়েছে সমাজের জন্য, দেশের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করে বাঁচার মধ্যে। সেটা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি-সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এখানেই সুশিক্ষার গুরুত্ব অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। আমাদের শিক্ষা অনেকটাই নৈরাজ্যমুখী, চিন্তা-ভাবনাবর্জিত। অথচ মানুষ সঠিক শিক্ষাগ্রহণ না করলে তার প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। সে কারণে আমাদের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য একটা সামাজিক জাগরণ দরকার। একটি কথা মনে রাখা ভালো, সমাজ নিয়ে ভাবনার বয়স লাগে না, প্রয়োজন চিন্তা ও মানসিকতা। শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকলে সমাজের কোনো পরিবর্তন আসবে না। ভাবতে হবে চারপাশের মানুষ নিয়ে। পরিবর্তন ছাড়া সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের সবার মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণই পারে সমাজ ও রাজনীতির চেহারা বদলে দিতে।