বাংলা সংস্কৃতিতে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অবদানের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। একটি পরিবার কতভাবে এই অঙ্গণে নিজেদের অবদান রেখেছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। এখানে শুধু একটি বিষয়ের উল্লেখ করি। ভারতে নিজেদের শাসন পাকাপোক্ত করার জন্য একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির কথা ব্রিটিশরা অনেক দিন আগেই ভেবেছিল।
আরও ভেবেছিল, এই কাঠামো তৈরিতে শুধু ব্রিটেন থেকে ‘সিভিল সারভেন্ট’ আমদানি করলে চলবে না, দেশীয়দেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই হিসেবে ১৮৫৩ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা আইসিএস সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রথম ১০ বছর কোনো ভারতীয় এই পরীক্ষা উতরোতে পারেননি। প্রথম যিনি সফল হলেন তিনি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের মেজদা, মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় সন্তান। সেটা ১৮৬৩ সাল।
সে বছর যে ৫০ জন আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন তাঁদের মধ্যে মেধাক্রমে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন ৪৩তম। তখনকার নিয়মানুযায়ী অক্সফোর্ডে এক বছর কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে কলকাতায় ফিরলেন তিনি। সত্যেন্দ্রনাথের এই সাফল্যে কলকাতার সুধী সমাজে আনন্দের লহর বয়ে গেল। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁকে নিয়ে সনেট লিখলেন। কাগজে-কাগজে তাঁর প্রশস্তি রচিত হলো। বেলগাছিয়ায় আয়োজন করা হলো বিরাট নাগরিক সংবর্ধনার। সেখানে উপস্থিতদের অন্যতম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ও। মেধাক্রমে পিছিয়ে থাকার কারণে সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম পোস্টিং হলো বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে। কিন্তু নাগরিক সংবর্ধনায় উপস্থিত অধিকাংশ তো হাজার হলেও বাঙালি। দাবি উঠলো, তাঁকে বাংলায় নিয়োগ দিতে বড়লাটের কাছে দরবার করার। (ভারতের রাজধানী তখনো কলকাতায়। তাই বড়লাট সেখানেই থাকতেন।) কিন্তু সেই গণদাবি নস্যাৎ করে দিলেন সত্যেন্দ্র নিজেই। বললেন, এই নিয়োগ যৌক্তিক এবং নির্দিষ্ট দিনে কলকাতা থেকে রেলগাড়িতে চড়ে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) রওনা হলেন।
এর ঠিক ১৪০ বছর পর ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে ত্রিধাবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ১২৮৮ জন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করা হলো, যা ২১তম বিসিএস বলেই পরিচিত। নিয়োগপ্রাপ্তদের একজন মেহেদী হাসান, যিনি পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব পর্যন্ত হয়েছিলেন। এই মেহেদী হাসান আজ ৭ জুলাই, ২০২৩ তারিখে ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছেন। তবে সেই শিরোনামে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কেউ কোনো স্তুতি খুঁজে পাননি। কারণ, তিনি শিরোনাম হয়েছেন চাকরিচ্যুতির কারণে। তাও যে সে কারণ নয়। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নারী নিগ্রহের মতো অপরাধে। তাও দেশে নয় বিদেশে বসে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি এত সব অপকর্ম করেছেন। এই আলাপে একটু পরে আসি।
ব্রিটিশরা তাদের আমলে নিয়োগ দিত ‘সিভিল সার্ভেন্ট’। আমরাই এর বঙ্গীকরণ করতে গিয়ে বানিয়েছি ‘সরকারি কর্মকর্তা’। ব্রিটিশরা এই সিভিল সার্ভেন্টদের সেবক হিসেবে নিয়োগ দিলেও তাঁরা বকলমে শাসকই ছিলেন। আমরা ব্রিটিশ তাড়িয়েছি, পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছি, কিন্তু এই সিভিল সার্ভেন্টদের মনের ভেতরে থেকে ‘শাসক’-কে বিতাড়িত করতে পরিনি। বরং সেই উত্তরাধিকার উত্তরোত্তর আরও পোক্ত হয়েছে। কখনো কখনো রাজনীতিকদের বিকল্পও বটে। এই গলদ দূর করার কথা মুখে বললেও কখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা কেউ নিয়েছেন, তেমনটা শুনিনি। তবে ভারতীয় সিনেমায় মাঝে মাঝে এমন সরকারি সেবকের দেখা মেলে বটে।
যাক সেসব কথা, মেহেদী হাসানের বিষয়টিতে ফিরে আসি। ২০২১ সালের ৪ আগস্ট দেশ রূপান্তর পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘শেষ সম্বল বিক্রি করে তারা পাড়ি জমান মরুর দেশ সৌদি আরবে। দুরুদুরু বুকে বিদেশ যাত্রার সময় বাংলাদেশি নারীদের মনে দানা বাঁধে সৌদি নিয়োগকর্তার লিপ্সার শিকার হওয়ার ভয়। কিন্তু স্বদেশির যৌনলিপ্সার শিকার হচ্ছেন তারা। তাও খোদ দূতাবাসের ভেতরেই। যে দূতাবাস সার্বভৌমত্বের প্রতীক, বিদেশ-বিভুঁইয়ে এক টুকরো বাংলাদেশ, সেখানেই তারা সম্ভ্রম হারিয়ে দেশে ফিরছেন।’
এই স্বদেশি হলেন মেহেদী হাসান। ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সিলর (শ্রম) পদে নিয়োগ পান। দেশ রূপান্তরে আরও লেখা হয়, ‘দূতাবাসে আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়া অল্পবয়সী গৃহকর্মীদের টার্গেট করতেন তিনি। তাড়াতাড়ি দেশে ফেরত পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতেন। যারা রাজি হতেন না, তাদের সেইফ হোমে রেখেই রাজি করানোর চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন উপলক্ষে উপহার সামগ্রী পাঠাতেন। তারপরও সম্পর্ক স্থাপনে রাজি না হলে জোর করতেন। এসব কাজের জন্য তিনি অফিস-পরবর্তী সময় বেছে নিতেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য তিনি বিকেল ৫টার পর আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়া নারীদের ডেকে পাঠাতেন। দূতাবাসের থার্ড লেবেলের কর্মকর্তা হয়েও তিনি নিজস্ব একটা নিয়মকানুন তৈরি করেছিলেন। একমাত্র তার অনুমতি ছাড়া কোনো গৃহকর্মী বাংলাদেশে ফিরতে পারবে না-এ ধারণার জন্ম দিয়ে ভীতি সঞ্চার করতেন। তিনি যৌনলিপ্সা চরিতার্থের জন্য অপ্রয়োজনীয় সাক্ষাৎকার প্রথা চালু করেন। তার এসব অনিয়ম প্রমাণ করতে না পারলে চাকরি হারাবেন এ ভয়ে অধীনস্থ কর্মচারীরাও চুপ থাকতেন। কিন্তু তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় এক গৃহকর্মীর সাহসে।’
ওই সময় সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. জাভেদ পাটোয়ারির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ঘটনার সত্যতা দ্রুত বেরিয়ে আসে। তিনি অভিযুক্ত মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন। কারণ দূতাবাসের গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছে, ‘গৃহকর্মীদের ভয় দেখিয়ে, গণহারে অশ্লীল প্রশ্ন করে যৌন নির্যাতন করতেন এবং ধর্ষণের টার্গেট নির্ধারণ করতেন। এসব প্রমাণিত হয়েছে। অশ্লীল প্রশ্ন করা এবং অশালীন আচরণ করা মেহেদীর বিকৃত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মেহেদী তার যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য একান্তে সাক্ষাৎকার নিতেন’। কমিটি সরকারের কাছে ‘মেহেদীর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গুরুদণ্ড আরোপ করার সুপারিশ’ করেছে। বলা হয়, ‘সরকার যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে, সেখানে রক্ষকের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তার এরূপ ভয়ংকর অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা যেতে পারে।’
এত কিছুর পর ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মেহেদী হাসানকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে বিভাগীয় মামলা হয় এবং ওই বছর ১০ মার্চ তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরে আরও এক দফা কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর কোনো জবাবই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। যে কারণে গতকাল বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই, ২০২৩) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে তাঁর চাকরিচ্যুতির কথা জানায়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘তদন্তে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে দূতাবাসের সেইফহোমে আশ্রিত কতিপয় গৃহকর্মীকে অপ্রয়োজনীয় একান্ত সাক্ষাৎকারের নামে অশ্লীল প্রশ্ন ও আচরণসহ বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা এবং যৌন নির্যাতন (ধর্ষণ) করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে অসদারণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ’প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ‘ফলে মেহেদীর দাখিলকৃত জবাব ও তদন্ত প্রতিবেদনসহ সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের গুরুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ’ (সূত্র: বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম)
মেহেদী হাসানের এই শাস্তির বিষয়টি জানার পর দুটি বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক. বিদেশে বসে ধর্ষণ, যৌন হয়রানির মতো অপরাধ করেও একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার শাস্তি কি শুধুই চাকরিচ্যুতি হতে পারে? দেশের কী কোনো আইন নেই তাঁকে এই অপরাধে বিচারের মুখোমুখি করার। ২০১৩ সালের ১১ জুন সন্ত্রাস বিরোধী (সংশোধন) বিল পাস হয় জাতীয় সংসদে। সেই বিলে বলা হয়েছিল, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রে অপরাধ সংঘটন করে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে, যা বাংলাদেশে সংঘটিত হলে এ আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য হত, তাহলে উক্ত অপরাধ বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং যদি তাকে উক্ত অপরাধ বিচারের এখতিয়ার সম্পন্ন কোনো বিদেশি রাষ্ট্রে বহিসমর্পণ করা না যায়, তাহলে উক্ত ব্যক্তি ও অপরাধের ক্ষেত্রে এ আইনের বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে।’ সরকার সন্ত্রাস দমনের জন্য এই বিল পাস করেছিল, এটা সত্য। কিন্তু মেহেদী যা করেছেন সেই অপরাধ কি এরচেয়ে কম? আর বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের দূতাবাস তো সার্বভৌম। তাহলে বাধাটা কোথায়? ধর্ষণ, যৌন হয়রানির মতো ঘটনা প্রাথমিকভাবে প্রমাণের আড়াই বছর পরও কেন চাকরি নিয়ে টানাটানি করা ছাড়া অন্য কোনো মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া করা হলো না? নাকি ভূক্তভোগীরা গরিব, অসহায় বলে রাষ্ট্র সেখানে নির্বিকার থাকা শ্রেয় মনে করেছে? আর কেউ যদি এই অভিযোগ করেন, মেহেদী হাসান সরকারি কর্মকর্তা বলেই শুধু চাকরি হারানোর ‘গুরুদণ্ড’ পেয়েই পার পেয়ে গেলেন- তাহলে কি তাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে?এখানেই রাষ্ট্রের পরীক্ষা? পরীক্ষা সেই সেবকদের, জনগণের করের পয়সায় যাদের সংসার চলে।
আর ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রতিরোধে সরকার এতটাই কঠোর যে, ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর অধ্যাদেশ জারি করে ধর্ষণের মতো অপরাধের সাজা মৃত্যুদণ্ড করা হয়। পরে তা সংসদে আইন আকারে পাস হয়েছে। ধর্ষণের সাজার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান যখন এই তখন একই অপরাধ করার পরেও একজন সরকারি কর্মকর্তাকে বিচারের কাঠগড়ায় না তুলে কীভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়? এসব যখন হতে থাকে তখন মাঝে মাঝে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে হয় যে, আমাদের বোধ শক্তি লোপ পেল কিনা!
দ্বিতীয়ত. মেহেদী হাসানের পরিবার ও স্বজনেরা বিষয়টি কী চোখে দেখছেন? মধ্য বয়সী এই চাকরিচ্যুত সরকারি কর্মকর্তা নিশ্চয় তদন্ত কমিটির মতো পরিবারের সদস্যদের কাছে সব দোষ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তাঁরা কি তা বিশ্বাস করেছেন? মেহেদী হয়তো তাঁর চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারেন, তাতে তাঁর বর্ম আরও শক্ত হবে। কিন্তু সমাজে যাদের সাথে তাঁর মেলামেশা তাঁরা কি আগের মতোই তাঁকে মেনে নিতে পারছেন? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে বলতে হবে এ সমাজ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। ঘুষসহ সবকিছু মান্যতা পেতে পেতে সেবকেরা এখন শাসকের এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন যে, তাঁদের কোনো অপকর্মই কোনো অপরাধ নয়। সমাজের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়া এই ক্ষততে আজ মলম লাগানোর লোকটির খুব দরকার।
পার্বত্যকণ্ঠ নিউজ /এমএস