মেজর নাসিম হোসেন (অব.)- পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে দেশের গণমাধ্যমে স্থান করে নিচ্ছে ইতিপূর্বে অশ্রুত সংগঠন কুকি ন্যাশনাল ফ্রন্ট। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে এমনিতেই সাধারণ মানুষ তো বটেই প্রশাসনিক কর্মকর্তা, বিশেষ বুদ্ধিজীবী এবং গণমাধ্যমের অনেকের জানাশোনা যথেষ্ট গভীর নয়। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম বলতে আমাদের অনেকের সামনে যে ছবিটা ভেসে আসে, তা হলো কোনো দৃষ্টিনন্দন অবসরযাপন কেন্দ্রের ছবি। কিছুদিন আগ পর্যন্ত মানুষের কাছে সাজেক ছিল এক অজানা পাহাড়। আজ পর্যটকের ভারে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে দেশের উওর পূর্ব সীমান্তের লুসাই হিলের পাদদেশ।
উপর থেকে খুবই দৃষ্টিনন্দন মনে হলেও সবুজ বনানীর নিচে পাহাড়ের খাদের চড়াই-উৎরাইয়ের মতো এর সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে আছে অনেক অজানা তথ্য। কুকিরা কেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা জানার জন্য আনন্দ বিকাশ চাকমার লেখা ‘কার্পাস মহল থেকে শান্তি চুক্তি-পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় নীতির ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে তুলে আনা নিচের (১-৮) তথ্যগুলো আপনাকে সমক্য ধারণা দেবে:
১. ১৮২৪ সালের ইঙ্গ- বার্মিজ যুদ্ধের মাধ্যমে কার্পাস মহলের প্রতিবেশী রাজ্য আরাকান ব্রিটিশ দখলাধীনে চলে আসে।
২. উক্ত যুদ্ধের পর ১৮২৬ সালে সম্পাদিত ইয়ানদাবো চুক্তির শর্তানুসারে বর্মী রাজা তাঁর প্রভাবাধীন করদরাজ্য আসাম, কাছাড় ও মনিপুর ব্রিটিশদের নিকট ছেড়ে দিলে সমগ্র উওর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক হিসাব নিকাশ নতুন মোড় নেয়। এসময় চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশদের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম বন্দরকে রপ্তানি বন্দর হিসাবে গড়ে তোলা। এই বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি হবে কাছাড়, সুরমা উপত্যকা ও মনিপুরে উৎপন্ন দ্রব্য।
৩. বার্মা থেকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে অবাধ বিচরণশীল স্বাধীন চেতা অদম্য উপজাতিরা (সেন্দু, বনযোগী, মুরং, খুমী, খিয়াং) ব্রটিশদের এ অঞ্চলে অনুপ্রবেশ, তাদের অবাধ স্বাধীনতার প্রতি হুমকি মনে করে। ফলে কোম্পানি সরকার ও উপজাতিদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। অদম্য উপজাতিরা তাদের লুটতরাজ, খুন, জ্বালাও-পোড়াও অপহরণ প্রভৃতি অপরাধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ‘পূর্বাঞ্চলের মারাঠা’ হিসাবে আবির্ভূত হয়। ১৮৩০ এর দশক নাগাদ কোম্পানি বসতি ও সীমান্ত চৌকীর উপর আক্রমণ দিয়ে শুরু হয় এ সংঘাত। শুধু তাই নয় যুদ্ধবাজ উপজাতিরা এিপুরা রাজা, চাকমা রাজা এবং বোমাং রাজাদের ভাড়াটে সেনা হিসাবেও সম্পদ বানাতে থাকে।
৪. চাকমা রানী কালিন্দীর শাসনাধীন কার্পাস মহলেও (পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ব নাম) তার অধীনে থাকা দেওয়ানদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। তাঁর দুই প্রভাবশালী দেওয়ান গিরিশ চন্দ্র দেওয়ান ও ত্রিলোক চন্দ্র দেওয়ানের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ আরম্ভ হয়। তারা উভয়ে কুকিদের ভাড়াটে সৈনিক হিসাবে ব্যবহার করে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনে। এক পর্যায়ে ত্রিলোক চন্দ্র দেওয়ান বিপক্ষ দলের ভাড়াটে কুকিদের হাতে প্রাণ হারালে তার ছেলে নিল চন্দ্র দেওয়ান মর্মাহত হয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত মীমাংসার জন্য তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
৫. সেজন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের সাহায্য ও আশ্রয় লাভের আশায় চট্টগ্রামের ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট বিরোধ মীমাংসা এবং নিষ্ঠুর ও দুর্ধর্ষ কুকিদের বশে আনার জন্য যে প্রভূত অর্থ ও শক্তির ব্যয় প্রয়োজন সে তুলনায় ঐ রাজ্য দখল করে আর্থিকভাবে সরকারের লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানান।
৬. ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যান অ্যাক্ট ফর দ্য বেটার গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া’ শীর্ষক একটি আইন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পাস করে। ১৮৬০ সালে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে একটি প্রশাসনিক জেলা গঠন ছিল একদিকে উপজাতি গুলোর অন্তর্কোন্দল ও আন্তঃউপজাতি আক্রমণ পাল্টা আক্রমণজনিত ঝঞ্ঝাটপূর্ণ অশান্ত পরিস্থিতি তৃতীয় শক্তি হিসাবে ব্রিটিশদের পূর্বমুখী সম্প্রসারণের কৌশলগত প্রয়াস।
৭. ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) জেলার ব্রিটিশ প্রজাদের উপর লুণ্ঠনপ্রিয় কুকি উপজাতিরা ভয়াবহ আক্রমণ চালায়, ম্যাকেঞ্জি যাকে ‘ গ্রেট কুকি ইনভেশান ‘ বলে আখ্যা দেন। ৪০০-৫০০ কুকি দল ১৫টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং ১৮৫ জন ব্রিটিশ প্রজাকে বন্দি করে নিয়ে যায়।
৮. ১৮৬০ সালে বৃটিশ সরকার অধিগ্রহণ করে চট্টগ্রাম জেলার নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চল। আরাকান থেকে আসাম পর্যন্ত গিরিবহুল অরণ্য অঞ্চলে অনগ্রসর অধিবাসীদের বসবাস। এদের মধ্যে লুসাই কুকিরা তখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ প্রভাবাধীন ভূখন্ডে রীতিমতো উৎপাত চালাচ্ছে। ক্যাপ্টেন লুইনের ভাষায়-
“কিন্তু পূর্ব সীমান্তে রয়েছে আমাদের কাছে কুকি নামে পরিচিত, স্বাধীন উপজাতিসমূহ। তবে তাদের বর্গনাম অনুসারে সঠিকভাবে বললে তারা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং একটা আগ্রাসী জাতি।,,,,এই লুসাইরা ছিল একটা স্থায়ী সমস্যা, যাদের নিয়ে সব স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃপক্ষকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। স্থানীয় অধিবাসীদের উপর হামলা চালিয়ে লুন্ঠন করে, গ্রামসমূহ জ্বালিয়ে দিয়ে, মানুষ হত্যা করে এবং শিশুদের অপহরণ করে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর বারবার অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল।”
উপরের তথ্যগুলো বলে দেয় কুকিদের আজকের উত্থানের পিছনে কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে অনেকেই চাকমাদের সমস্যা বলে ভুল করি। বিগত ১৯৭২-৯৭ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে চাকমাদের অগ্রগন্যতা আমাদের অনেকের কাছে তেমনটি বুঝতে বাধ্য করে।
চাকমা ছাড়াও মারমা ত্রিপুরা সম্প্রদায় শান্তি বাহিনীতে উল্লেখযোগ্য হারে অংশগ্রহণ করলেও অন্য পাহাড়ি সম্প্রদায় যেমন, বম, খুমি, বনযোগী, ম্রো, মুরং ইত্যাদির অংশগ্রহণ নামমাত্র বা তারা কখনো কোন উচ্চ পদে ছিলো না। এক্ষেত্রে একটা বিষয় সকলের জানা দরকার, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধিবাসীদের ভিত্তিগতভাবে দু’ভাগে ভাগ করা যায়- খ্যাংথা বা নদীর সন্তান। এরা কৃষি ভিত্তিক জীবনের উপর নির্ভরশীল। এরা নদী বা ছড়ার কাছাকাছি থাকে, নৌকা চলাফেরা করে। সাধারণ টিলায় বসবাস করে। চাকমা, মারমা ত্রিপুরা, তঙ্চঙ্গা এরা এই গোত্রের। কাপ্তাই বাঁধের কারণে এরা কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
‘টংথারা হলো ওপর গোষ্ঠী যারা নদী এড়িয়ে চলে, নদীকে ভয় পায়, উঁচু পাহাড়ের উঁচু মাচান ঘরে এরা বসবাস করে এবং নিজের হাইল্যান্ডার এবং হান্টার রেস হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। পার্বত্য চুক্তির কম সুবিধাভোগী গোত্র এরা। জেএসএস বা সশস্ত্র শাখায় তাদের উপস্থিতি ছিলো অতি নগন্য। তার একটা প্রতিফলন দেখা যায় চুক্তির পর তারা কোটা ব্যবস্থার কোন সুবিধা পায়নি। সরকারি চাকুরিতে কোটার সুফল থেকে তারা বঞ্চিত। আরেকটি মৌলিক ব্যবধান রয়ে গেছে এই ‘খ্যাংথা’ (নদীর সন্তান) এবং’ টংথা’ বিভাজনে। সেটা হলো বর্তমানে টংথারা বা হাইল্যান্ডার বা সামগ্রিকভাবে কুকিরা ব্যাপক সংখ্যায় খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে।
কুকিরা কেন নিজেদের বঞ্চিত মনে করে?
কুকিরা তাদের ঐতিহ্যগত কারণে নিজেদের হান্টার রেস হিসাবে সুপেরিয়র মনে করে। তারা বীরের জাতি, অপর জাতের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়ে তারা টিকে আছে। তারা তাদের ভূমিতে অন্য কারো প্রবেশকে মেনে নেয় না। অনুপ্রবেশকারীর বিচ্ছিন্ন মস্তক একজন হাইল্যান্ডার তরুণের শৌর্যের প্রতীক। হেড হান্টার হিসাবে পরিচিতি দিতে এবং শত্রুর ছিন্ন মস্তকের খুলি ঘরের প্রবেশ পথে ঝুলিয়ে রাখতে তারা পছন্দ করে।
কেএনএফ নিজেদের পার্বত্য অঞ্চলে নিজেদেরকে প্রাচীন অধিবাসী দাবি করে। তারা আসাম, মিজোরাম, মনিপুর ও আরাকানের জ্ঞাতি কুকিদের সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করে দেখে। তারা মনে করে, এই এলাকা থেকে চাকমারা তাদেরকে উচ্ছেদ করে সে জায়গা দখল করেছে। তারা উওর-পূর্বের আসাম মিজোরাম মনিপুর থেকে শুরু করে আরাকান পর্যন্ত এলাকায় নিজেদের পৈতৃক ভূমি বলে দাবি করে।
বাংলাদেশের কুকিরা বান্দরবানের এই এলাকায় চাকমা আধিপত্য মানতে নারাজ। তারা এই এলাকায় চাকমানাইজেশনের বিরোধী। জেএসএস যেমন পাহাড়ে ইসলামাইজেশনের জিকির তুলে, তেমনি কুকিরাও পাহাড়ের এই অংশে চাকমা নেতৃত্ব মানতে নারাজ। তাদের প্রচারিত এক বর্ণনায় তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিসত্ত্বা দ্বারা অপরাপর ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বকে বিলীন করে দেওয়ার অভিযোগ করেছে। হাইল্যান্ডার হিসাবে গর্বিত কুকিরা কোন ক্রমেই কুকিদের উপর চাকমা আধিপত্য কায়েম করতে দিতে চায় না।
মিজোরামের লুসাইদের সাথে চাকমা পরিচালিত শান্তি বাহিনীর বিরোধ বেশ পুরানো। শান্তি বাহিনীর সাথে তারা বহুবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুরংরা শান্তি বাহিনীর বিরোধী ছিলো। শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামের সময় মুরং পাড়ায় কোনরূপ প্রবেশাধিকার ছিলো না।
বর্তমানে কুকিরা কেন তৎপর?
কুকিদের অভিযোগ বাংলাদেশ সরকার জেএসএস এর সাথে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে কুকিদের আদি নিবাস খ্যাত বান্দরবান-রাঙামাটির লুসাই হিলের পাদদেশের এই বিশাল অঞ্চল চাকমাদের কব্জাতে দিয়েছে। অতীতে চাকমা রানী কালিন্দী বৃটিশদের সহায়তায় কুকিদের বিতাড়িত করেছে, এখন তারা সেই পৈতৃক ভূমি পুনরুদ্ধারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের এই সংগ্রামে মিজোরাম, মনিপুর ও আরাকানের জ্ঞাতি ভাইদের সমর্থন আছে। মিজোদের জন্য এই সংগ্রামের সাফল্যের অর্থ হলো চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। কুকিদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা এমনও মতামত প্রকাশ করে যে তারা বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।
কুকিদের আন্দোলনের পিছনে মিজোরামের সার্বিক সমর্থন আছে। মিজোরামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের সাথে চুক্তির সময় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের অব্যাহত গ্যারান্টি চেয়েছিলো। বর্তমানের মিজোরামের শিল্প ও বাণিজ্যের সিংহভাগ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরটির উপর নির্ভরশীল। দুর্গম সাজেক থেকে মিজোরাম পর্যন্ত সড়ক পথের যোগাযোগ এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকে বাড়িয়ে তুলেছে। হাজার কোটি টাকা খরচ করে বানানো এই সড়কের বেনিফিশিয়ারি উওর-পূর্ব ভারতের ল্যান্ডলকড ৭টি রাজ্য।
পর্যটন বাণিজ্যের সোনার ডিম এই অঞ্চলের সকল সমীকরণকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এই বাণিজ্যের উপর একছত্র নিয়ন্ত্রণ কেএনএফের অন্যতম লক্ষ্য। তাই অপহরণ বাণিজ্যে মেতে উঠেছে তারা। যেন ভয়-ভীতি দেখিয়ে পর্যটনের প্রসার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। থানচি-রুমা-আলীকদমের দিকে পর্যটনের উপর স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণারোপ তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়েছে।
জেএসএস কেএনএফের উত্থানের পিছনে বরাবরই সরকারের মদদ দেখছে। কিন্তু এই আর্টিকেলের প্রথমে উল্লেখিত সূত্রগুলো প্রমাণ করে যে, কুকিদের নিয়ন্ত্রণ কতটা কষ্টসাধ্য। ব্রিটিশরা তাদের দমন করেছে একাধারে সামরিক চাপ ও তোষন নীতির মাধ্যমে। ব্রিটিশরাই তাদের বিরুদ্ধে পুরোপুরি সামরিক অভিযানে যায়নি, এর পিছনে সামরিক ব্যয় এবং তার পরিবর্তে অর্জনের হিসাব কষে। তারাও কুকিদের সাথে এক ধরনের কৌশলগত সমঝোতায় গেছে। কুকিদের উত্থান পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। তিনি আর জুম্মা জাতির একছত্র নেতা নন, এমনটা প্রমাণিত হবে যদি কেএনএফের আধিপত্য বজায় থাকে। তার মূল দল জেএসএস ইতোমধ্যেই চারখন্ডে বিভক্ত হয়ে তার নেতৃত্বের প্রতি আঙ্গুল তুলছে। এর মাঝে কুকিদের উত্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের চাকাকে সেই উনিশ শতকে ঠেলে দিচ্ছে।
কেএনএফ এর মদদ দাতা কারা?
কেএনএফ তাদের বিভিন্ন পোস্টে তাদের সহায়তাকারী উৎসসমূহের নাম গোপন রাখছে না। মিয়ানমারের চলমান সংঘাতে আরাকান আর্মির সাফল্যে তাদের উচ্ছ্বাস লক্ষ্যণীয়। তাদের পোশাক, অস্ত্র-সরঞ্জামের সাথে আরাকান ভিত্তিক সংগঠনগুলোর মিল আছে। তারা কুকি-চিন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় লর্ডস স্টেট বা খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। ইউরোপের খ্রিস্টিয় ধর্মানুসারীদের সহায়তায় ‘ইস্ট তিমুর’ মডেলের একটা কুকি রাষ্ট্র স্থাপনের স্বপ্ন দেখে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ শাসনতান্ত্রিক সংকট তীব্র হলে তারা আরো তীব্রভাবে তাদের তৎপরতা বাড়াবে। বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে যে রকম পরিস্থিতিতে জেএসএস সর্বাত্মক সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছিল, তারা বর্তমানে সে-রকম একটা সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুকে নিয়ে যেরকম অস্বস্তিতে আছে, তা কেএনএফকে উৎসাহ দিচ্ছে আরেকটা জুম্মাল্যান্ডের মতো সংগ্রামের দিকে বাংলাদেশকে ঠেলে দিতে। বাংলাদেশকে চাপে রাখতে জেএসএস বর্তমান পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে ইতোমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়ে উঠেছে। বান্দরবানে কেএনএফর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর তৎপরতা বাড়লে তারা অনেকটা ফাঁকা মাঠ পেয়ে যাবে নিজেদের আরো সংগঠিত করতে। তাই কেএনএফের তৎপরতাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোন কারণ নেই। এদের বিরুদ্ধে আরো শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।
এম/এস