মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, বান্দরবান ব্যুরো প্রধান:
অবশেষে বান্দরবানের লামার আলোচিত সুজন হোসেন (২৮) হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে লামা থানা পুলিশ। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা ও গোপন সংবাদের মাধ্যমে ঘটনার ৯ দিন পর বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকেলে পুলিশ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করে এবং ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আটক করতে সক্ষম হয়। নিহত সুজন হোসেন লামা পৌরসভা এলাকার নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মৃত চুকু মিয়ার ছেলে। আটককৃতরা হলেন- নিহত সুজন হোসেনের স্ত্রী নুর বানু (২৮) ও জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দক্ষিণ ছালামী পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীর ছেলে হানিফ (৩০)।
আটককৃতদের দেয়া তথ্য মতে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে লামা থানা পুলিশ জানায়, গত ২৩ জুলাই ২০২৪ইং সকাল ১১টায় লামা থানাধীন লামা সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা এলাকায় মাতামুহুরী নদীতে ভাসমান অবস্থায় একটি মরদেহ পাওয়া যায়। লামা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শরীরে পচন ধরা, ফুলে বিকৃত অবস্থায় একটি লাশ উদ্ধার করে। লাশের পরিহিত কাপড় চোপড় দেখে তা উপরে বর্ণিত ভিকটিমের মরদেহ মর্মে সনাক্ত হয়। এরপর পুলিশ মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট এবং ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে পরিবারের নিকট লাশ হস্তান্তর করে। ভিকটিমের ভাই মো. শরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে লামা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলা রুজু হওয়ার পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় এবং গোপন সোর্স নিয়োগ করে পুলিশ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন এবং আসামীদের সনাক্তের জন্য ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ১নং আসামীকে গ্রেফতারপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ এবং তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২নং আসামীকে গ্রেফতার ও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আলামত উদ্ধার করেন। গ্রেফতারকৃত আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভিকটিম এবং ২নং আসামী স্বামী স্ত্রী। তাদের ১১ বছর বয়সী ১টি ছেলে সন্তান এবং ৩ বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। ভিকটিম স্ত্রী এবং সন্তানসহ তার শশুর বাড়ীতে ঘর জামাই হিসেবে থাকতেন। পূর্বে তিনি হোটেল কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। কয়েক বছর যাবৎ সে শ্রমিকলীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতির সাথে জড়িত হন। পূর্বের পেশা ছেড়ে দেন। এরপর থেকে ভিকটিমের সুনির্দিষ্ট কোন পেশা এবং আয় ছিলনা। স্ত্রী এবং শাশুড়ীর আয়ে সংসার চলতো। প্রায় সময় ভিকটিম টাকার জন্য ২নং আসামিকে মারধর করতো। তার স্ত্রী কাজকর্ম করে এবং অনেক সময় লোন নিয়ে স্বামীর টাকার জোগান দিত। টাকা দিতে না পারলে মারধর করত এবং ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করত। ভিকটিম দেখতে সুদর্শন এবং কথা বার্তায় স্মার্ট ছিল। তিনি মোবাইল ফোনে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করত। নারীদের পিছনে টাকা পয়সা খরচ করত। এ নিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই মনোমালিন্য হতো। ঘটনার কয়েকদিন আগে টাকার জন্য ভিকটিম ২নং আসামিকে ব্যাপক মারধর করেছে এবং গলায় পা দিয়ে পাড়া দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল। ভিকটিম কর্তৃক মারধর এবং ভিকটিমের নারীঘটিত এ সকল বিষয় নিয়ে ২নং আসামী ভিকটিমের উপর ক্ষুদ্ধ হয়।
এদিকে গত ৩ মাস আগে ২নং আসামী ব্যক্তিগত কাজে পুরবী গাড়ীতে করে বান্দরবান সদরে যাওয়ার সময় ঐ গাড়ীর হেল্পার ১নং আসামীর সাথে পরিচয় এবং ফোন নম্বর বিনিময় হয়। এরপর থেকে উভয়ের মধ্যে মাঝে মধ্যে কথাবার্তা হতো। ২নং আসামী তার স্বামীর সাথে মনমালিন্য এবং স্বামীর নির্যাতনের বিষয়ে ১নং আসামীর সাথে শেয়ার করে। তারা উভয়ে মিলে ভিকটিমকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। ঘটনার কয়েকদিন আগে তারা ভিকটিমকে হত্যা করার জন্য এক বৈদ্যের সাথে যোগাযোগ করে। বান মেরে ভিকটিমকে মেরে ফেলার জন্য উক্ত বৈদ্যকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছিল। কিন্তু টাকা পাওয়ার পর বৈদ্য ফোন বন্ধ করে দেয়ায় তাদের এই পরিকল্পনা সফল হয়নি। এরপর তারা নিজেরাই ভিকটিমকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।
পরিকল্পনা মোতাবেক গত ২০ জুলাই ২০২৪ইং রাতে ভিকটিমকে হত্যা করার জন্য ১নং আসামী চকরিয়া থেকে লামা আসে। ঐদিন খাবারের সাথে ভিকটিম সুজনকে ঘুমের ঔষুধ খাওয়াতে না পারায় তারা ঐদিন পরিকল্পনা বাতিল করে। ১নং আসামী লামা সদরে অবস্থান করে। এরপর গত ২১ জুলাই ২০২৪ইং ২নং আসামী ডাক্তার দেখানোর জন্য তার মা এবং কন্যাকে নিয়ে লামা বাজারে যায়। ডাক্তার দেখানোর পর পরদিন আবার ডাক্তার দেখাতে হবে বলে কৌশলে তাদেরকে ভিকটিম সুজনের ভাইয়ের বাসায় রেখে আসে। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ঐদিন রাতের খাবারের সাথে ২নং আসামী ভিকটিমকে ৩টি ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। ঔষধের প্রভাবে ভিকটিম ঘুমিয়ে পড়ে। ভিকটিম ঘুমিয়েছে নিশ্চিত হয়ে ২নং আসামি ১নং আসামি ফোনে জানালে রাত ১১টায় ১নং আসামী ঘরে প্রবেশ করে। ২নং আসামী গামছা দিয়ে ঘুমন্ত ভিকটিমের পা বেঁধে ফেলে। ১নং আসামী ভিকটিমের গায়ের উপর উঠে কম্বল দিয়ে নাক-মুখ চেপে ধরে। এর মধ্যে ভিকটিম ঘুম থেকে উঠে ধস্তাধস্তি করলে তার পায়ের বাধন খুলে যায়। এ অবস্থায় ১নং আসামী ভিকটিমের নাকে এবং মুখে কিল ঘুষি মারে এবং গামছা দিয়ে ভিকটিমের গলা পেঁছিয়ে ধরে এবং ২নং আসামী ভিকটিমের অন্ডকোষ চেপে ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিকটিমের দেহ নিস্তেজ হয়ে যায়। রাত অনুমান ২টায় আসামীরা কাঁধে করে ভিকটিমের লাশ নিয়ে নিকটস্থ ঝিরিতে ফেলে দিয়ে আসে। পানির স্রোতে ভেসে লাশ মাতামুহুরী নদীতে চলে যায় এবং ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়।
সুজন হোসেন হত্যার ঘটনায় দুই জনকে আটকের সত্যতা নিশ্চিত করে লামা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শামীম শেখ বলেন, আটককৃতরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর তাদের জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।