মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ব্যুরো প্রধান, বান্দরবান:
বান্দরবানের লামায় পাহাড়ের ঢালুতে সবজি চাষের বিপ্লব ঘটিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে কৃষকরা। উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের বদরটিলা ও মিনঝিনি এলাকায় পাহাড়ের ঢালুতে অনাবাদি প্রায় ১৫০ একর জমিতে বেগুন, শশা, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়শ, ঝিংগা, তিতকরলা, মরিচ, চিনার, লাউ, বরবটি, চিচিংগা ও বিভিন্ন জাতের পেঁপে সহ মিশ্র সবজির চাষাবাদ হয়েছে। বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় স্থানীয় এবং পার্শ্ববর্তী চকরিয়ার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের দুই শতাধিক কৃষক পাহাড়ের ঢালু জমিতে সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
পাহাড়ের ঢালুতে বর্ষা মৌসুমে সবজি চাষ করে অধিক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বদরটিয়া এলাকার প্রবীণ কৃষক আনোয়ার হোসেন ও মনু মিয়া। গত বছর তারা ৪ একর সবজি চাষ করে তিন লাখ টাকা আয় করেন। ফাইতংয়ে বদরটিলা এলাকায় কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ইসলামনগর গ্রামের কৃষক আবুল হাসেম ৮০ শতক (২ কানি) জমিতে বেগুন, শশা, মিষ্টি কুমড়া ও ঝিংগা চাষে ৬৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। ক্ষেতে ফসল ওঠার পর দেড় থেকে ২ লাখ টাকার সবজি বিক্রির স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
কৃষক আবুল হাসেম জানান, বর্তমানে এই এলাকাকে মানুষ আদর্শ সবজি খামার এলাকা হিসেবে চেনে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আড়তদার, ব্যবসায়ীরা এসে বদরটিলা এলাকা হতে সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেত থেকে তরতাজা সবজি তুলে ক্ষেতে রেখেই বিক্রি করে নগদ টাকা গুনছে কৃষকরা। ৩/৪ মাস সময়ের ব্যবধানে তারা মূলধনের দুই থেকে তিন গুণ টাকা লাভ করছে। বদরটিলায় চাষাবাদ করেন এমন আরো কয়েকজন কৃষক হলেন মাহবুবুল আলম, নুরুল আবচার ও মোঃ হেলাল। তারা বলেন, পাহাড়ি জমি হওয়ায় জমির খাজনা খুব কম। ২ কানি জমির খাজনা বছরে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। আর বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে অনেকাংশে নিরাপদ। মাটি উর্বর হওয়ায় সমতল জমির মতো কীটনাশক ও সার ব্যবহার করতে হয়না। সবজি চাষে আমরা নিজেরাও শ্রম দিই। বর্ষাকালীন পাহাড়ে চাষাবাদ হয়। বর্ষা এলে সমতল জমি পানির নিচে ডুবে থাকায় আমরা বেকার হয়ে যেতাম। গত ৬/৭ বছর থেকে বর্ষাকালে পাহাড়ে চাষাবাদ করে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় দরিদ্রতা মুছে সবাই সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখছি।
সরজমিনে দেখা যায়, চলতি বর্ষা মৌসুমে লামা ও পার্শ্ববর্তী চকরিয়া উপজেলার শত শত একর পাহাড়ের ঢালু জমিতে মাচাং বানিয়ে বিভিন্ন রকমের সবজি চাষ করা হয়েছে। বছরের এইসময় চাষিরা বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের বদরটিলা, মিনঝিরি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের মিরিঞ্জা পাহাড়, হারগাজা, গয়ালমারা, বনপুর, রূপসীপাড়া ইউনিয়নের দরদরী, অংহ্লা পাড়া, পুকুরিয়াখোলা, মংপ্রু পাড়া, লামা সদর ইউনিয়নের বৈল্যারচর, বেগুনঝিরি, ক্যাংঝিরি, মেওলারচর, বরিশাল পাড়া, সরই ইউনিয়নের আন্ধারি পাড়া, আমতলী, ধূইল্যাপাড়া, আজিজনগর ইউনিয়নের ছিয়ততলী, ক্যামবাজার, হিমছড়ির বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় বেগুন, ঝিঙ্গা, করলা, শশা, কাকরোল, শিম, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়শ, তিতকরলা, মরিচ, চিনার, লাউ, চিচিংগা ও বিভিন্ন জাতের পেঁপেসহ নানা সবজির চাষ করেছেন।
কৃষক মোঃ হেলাল বলেন, সবজি ক্ষেত থেকে নিয়মিত ফসল তোলা শুরু হয়েছে। এখন প্রতিদিন বদরটিলা এলাকা হতে বিভিন্ন প্রজাতির ১০/১২ টন সবজি সরবরাহ হচ্ছে। এখানের সবজি দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। এখানে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় বেগুন। এখানের বেগুন বিখ্যাত। এছাড়া ঢেঁড়শ, লাউ, বরবটি, তিতকরলা, কাঁকরোল, মিষ্টি কুমড়া, শশা, কলা, চিনার, গুনচি, মরিচ, ঝিংগা, চিচিঙ্গা চাষ হয়। আমরা কীটনাশকের ব্যবহার কম করে প্রাকৃতিক জৈব সারের ব্যবহার বেশি করছি। পাইকারী সবজি ব্যবসায়ী মোঃ আলমগীর। তিনি বলেন, আজকে আমি প্রায় ৫ হাজার কেজি বেগুন ও ২ হাজার কেজি শশা ক্রয় করেছি। প্রতি কেজি বেগুন পাইকারি ৪৫ টাকা ও শশা প্রতি কেজি ৪০ টাকা করে ক্রয় করেছি। এখন বাজারে সবজির দাম ভালো থাকায় চাষিরা লাভবান হবেন।
স্থানীয় ইউপি মেম্বার থোয়াইহ্লা চিং মার্মা বলেন, পাহাড়ে চাষীদের চাষ দেখে অনেকেই অবাক। অনেকে এখন অনাবাদি জমিতে সবজি চাষে আগ্রহী হচ্ছে। আমরাও সবাইকে ক্ষতিকর তামাক চাষ থেকে ফিরে সবজি চাষে ঝুঁকতে পরামর্শ দিচ্ছি।
লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন চন্দ্র বর্মন বলেন, পাহাড়ের ঢালুতে কৃষকরা সবজি চাষ করে যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন, তা সত্যিই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বর্ষা মৌসুমে সমতল ভূমিতে পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে অধিকাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যায়। পাহাড়ি জমিতে কোনো ধরনের পানি জমে না থাকার কারণে সবজির ফলন ভালো হয়।
পার্বত্যকন্ঠ নিঊজ/রনি