ক্যাম্পের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে লাগানো কাঁটাতারের বেড়া কেটে নিজেদের মতো দুই শতাধিক গেট তৈরি করার অভিযোগ উঠেছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। নিয়ন্ত্রণহীন সেসব গেট দিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি লোকালয়ে গিয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পের বাইরে যাওয়া এসব রোহিঙ্গাকে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পাশেই উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের অবস্থান। এই ক্যাম্পের চারপাশে রয়েছে কাঁটাতারের নিরাপত্তা বেষ্টনী। কিন্তু এই ক্যাম্পের এক কিলোমিটার এলাকায় ১০টি অংশে কাঁটাতারের বেড়া কেটে তৈরি করা হয়েছে গেট। আর এসব গেট দিয়ে নিজেদের মতো করে অবাধে যাতায়াত করছে রোহিঙ্গারা।
কুতুপালংয়ের আমগাছতলা এলাকায় দেখা যায়, কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে রয়েছে একটি গ্রিলের গেট। এই গেট পার হয়ে সহজে ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা। একই গেটের পাশে রয়েছে একটি ছোট ফাঁক। ওই ফাঁক দিয়েও ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছে শত শত রোহিঙ্গা।
ক্যাম্প-২ ইস্টের ব্লক এ/৭-এর বাসিন্দা ওমর ফয়সাল (৩১) বলেন, ক্যাম্প থেকে বের হয়েছি কাজে যাওয়ার জন্য। রাস্তায় দাঁড়িয়েছি গাড়িতে ওঠার জন্য।
ক্যাম্প-২ ব্লক-বি এর বাসিন্দা মোহাম্মদ রফিক বলেন, ক্যাম্পের ভেতর থাকি। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়ার কারণে ক্যাম্প থেকে বের হতে পারি না। তাই কাঁটাতারের বেড়া কেটে যেসব স্থানে ফাঁক করা হয়েছে, সেদিক দিয়ে বের হয়ে বাজারে যাচ্ছি।
কুতুপালং রেজিস্ট্রার ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইছহাক বলেন, কাঁটাতারের বেড়ার কারণে ক্যাম্প থেকে সহজে যাতায়াত করা যায় না। এ জন্য অনেকেই কাঁটাতার কেটে ফাঁক করেছে ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার জন্য। এখন ওই ফাঁক দিয়ে ক্যাম্প থেকে বের হয়েছি। অটোরিকশা চালাব আর কাজকর্ম করব।
কুতুপালং রেজিস্ট্রার ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা ছলমা খাতুন বলেন, কুতুপালং ক্যাম্প থেকে বের হয়েছি বালুখালী যাওয়ার জন্য। সেখানে আত্মীয়ের বাড়িতে যাব।
শুধু এই ক্যাম্পে নয়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পেও কাঁটাতারের বেষ্টনীর ২০০ অংশে কেটে রোহিঙ্গারা নিজেদের ইচ্ছেমতো গেট তৈরি করে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাচ্ছে লোকালয়ে। তারপর কক্সবাজারসহ দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
বালুখালী ক্যাম্প ৮-এর বাসিন্দা ইউসুফ বলেন,এপিবিএনের চেকপোস্ট আছে। তাই কাঁটাতারের বেড়া যেদিকে কাটা ছিল; ওইখান দিয়ে বের হয়েছি। সারা দিন উখিয়ার একটি গ্রামে কৃষিকাজ করেছি। এখন কাজ শেষে ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছি।
টিভি টাওয়ার ক্যাম্প-২-এর বাসিন্দা খায়রুল আমিন বলেন, কে বা কারা কাঁটাতারের বেড়া কেটেছে জানি না। শুধু এখানে নয়, কিছুদূর পরপর কাঁটাতার কেটে যাতায়াতের অনেক পথ রয়েছে। এসব পথ দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে। শুধু রোহিঙ্গা নয়; ক্যাম্পে যারা এনজিও সংস্থায় চাকরি করেন তারাও এসব পথ ব্যবহার করেন।
ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া বন্ধে বসানো হয়েছে এপিবিএন পুলিশের চেকপোস্ট। কিন্তু অনেক সময় চেকপোস্টগুলোর শিথিলতার সুযোগে ফাঁকফোকর দিয়েও বের হচ্ছে রোহিঙ্গারা। একই সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ কিংবা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে তুলে নেয়া হয়েছে অনেক চেকপোস্ট। স্থানীয়দের দাবি, ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন,
গেল ৬ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা হয়নি। আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো আশাও দেখছি না। এর কারণে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে যেভাবে বের হচ্ছে এটা খুবই আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয়। এটা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকির বলে মনে করছি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। এভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তাই সরকার, প্রশাসন, সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ও মেরিন ড্রাইভে চেকপোস্টগুলো সচল করে নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা নাহলে রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
তবে ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন বলছে, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।