একটা সময়ে আশেপাশের প্রায় সব লোকজন বলতো আপনার তো তিন মেয়ে কোনো ছেলে নাই বংশের প্রদীপ জ্বালাবে কে? ছোটবেলায় প্রতিবেশীদের এমন কথায় কষ্ট পেতেন বাবা-মা। মা সবসময় বলতেন এমন কিছু করতে হবে যাতে এই প্রতিবেশিরাই প্রশংসা করে। সেই থেকে সংকল্প শুরু। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখেছি কিছু একটা করে দেখাতে হবে সেই স্বপ্নের পথে হেটে আজ আমরা দুই বোন একই সঙ্গে ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছি।
এলাকার লোকজনের মুখে এখন প্রশংসা শুনি। নিজের ও বোনের সফলতার বিষয়ে উম্মে সুলতানা ঊষা এভাবেই নিজের সফলতার কথাগুলো বলছিলেন আমাদেরকে।
আশা মনি ও উম্মে সুলতানা ঊষা দুই বোন। এবারের ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের জন্য দুজনই সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।রাজধানী ঢাকার সাভার পৌর এলাকার জামসিং মহল্লার বাসিন্দা সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট মো. আনোয়ার হোসেন ও রহিমা আক্তারের মেয়ে তারা। তাদের পৈত্রিক নিবাস মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলায়। ৪১ তম বিসিএসে এক সঙ্গে দুই বোনের সাফল্যে আনন্দে ভাসছে পরিবারটি।
বড় বোন আশা মনি ২০০৮ সালে সাভার রেডিও কলোনি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি, ২০১০ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.৯০ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। বর্তমানে তিনি ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে (৩৮ বিসিএস নন ক্যাডার) যশোরে কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড কমিশনারেটে কর্মরত রয়েছেন।
আশা মনির স্বামী দেওয়ান মওদুদ আহমেদ ৩১তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডার। স্বামীর কর্মনিষ্ঠা, বিনয়, সততা এবং মানবহিতৈষী কাজগুলো দেখে বিসিএসের জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছেন আশা মনি। বাবা-মায়ের দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়নেও ছিলো প্রবল আগ্রহ।
আশা মনি বলেন, স্বামীর কর্মনিষ্ঠা, সততা ও অন্যান্য গুণাবলি প্রতিনিয়তই আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে। আর আমার বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল আমরা উচ্চ পর্যায়ে যাবো, তাদের মুখ উজ্জ্বল করবো। আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি এখনো যে নেতিবাচক মনোভাব আছে আমাদের সাফল্যে তা দূর হয়ে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা।
বিসিএসের প্রস্তুতি সহজ ছিলো না আশা মনির। মেয়ে ফাইজা আহমেদকে (৫) নিয়ে তাকে নিতে হয়েছিল প্রস্তুতি। এরপরও সফল হয়েছেন তিনি। সফলতায় বেশ উচ্ছ্বসিত তিনি।
তিনি বলেন, সফলতা পেয়ে ভালো লাগছে। আমার জীবনের অন্যতম একটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার চেয়ে ছোট বোন ঊষার সাফল্যে আরো বেশি আনন্দিত আমি। সে এখন আমার বোন থেকে ব্যাচমেট, এক সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিব- এসব মুহূর্ত ভাবতেই ভালো লাগছে। দুই বোন এক সঙ্গে হয়ে মনে হচ্ছে শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে।
অপরদিকে, উম্মে সুলতানা ঊষা ২০১১ সালে সাভার রেডিও কলোনি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৪.৫০ পেয়ে এসএসসি এবং ২০১৩ সালে সাভার মডেল কলেজ থেকে একই বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন।
ঊষা জানান, বিসিএস পরীক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকাকালীন ২০১৭ সালে অংশ নেন ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায়। তবে সফল হতে পারেননি। এরপর মনোবল দৃঢ় করে সংকল্প করেন বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে। একটা সময় ফেসবুক চালানো বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ ফেসবুক চালালে অনেক সময় ব্যয় হতো। ফেসবুকের নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে এক ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে হতো। মানসিক শান্তি পেতে ফেসবুক চালানো বন্ধ করে দেই ২০২১ সাল থেকে। প্রয়োজনের বাইরে কারো সঙ্গে তেমন যোগাযোগ হতো না।
তিনি আরও বলেন, বিসিএস প্রস্ততি নিতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হতাশায় পরেছিলাম। তবে মায়ের অনুপ্রেরণায় আবার মনোযোগ দেই প্রস্তুতিতে। বড় বোন ও দুলা ভাইও হতাশা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছেন অনেক। অবশেষে গত ৩ আগস্ট ৪১তম বিসিএসের ফলের তালিকায় দুই বোনের রোল নম্বর একইসঙ্গে দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া বিসিএসএর স্বপ্ন ২০২৩ এ এসে পরিপূর্ণতা পায়।
এদিকে, আশা ও ঊষার বাবা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের সন্তানরা আল্লাহর রহমতে আত্মীয়স্বজন ও এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমাদের কোনো ছেলে সন্তান নেই বলে আমার কোনোদিন কোনো আক্ষেপ ছিল না। তবে পাড়া প্রতিবেশীরা অনেক কথাই বলতো। আজ তারাও আমার মেয়েদের সাফল্যে আনন্দ প্রকাশ করছেন। আশা ও ঊষার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করছি। আমার আরেক মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে তার জন্যেও সবার কাছে দোয়া চাইছি।
সাভার রেডিও কলোনী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক এইচ.এম. শাহ আলম মিঞা বলেন, তারা দুই বোন আমাদের স্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। আমরা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের এই সাফল্যে দারুণ উচ্ছ্বাসিত।