মাসুদ রানা, স্টাফ রিপোর্টার:
ক্রিকেটার হিসেবে একসময় কাঁপিয়েছেন মাঠ। নিজের দেশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। এরপর দেশ থেকে দুর্নীতির শেকল ভাঙার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা। পরে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া। আর এখন তিনি দুর্নীতি মামলায় জেলে। ধারণা করা হচ্ছে, অংশ নিতে পারবেন না নির্বাচনেও। বলা হচ্ছিল, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কথা।
গত শনিবার তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড পান ইমরান। ওই দিনই লাহোরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি। ইমরানের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ইসলামাবাদ থেকে ৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত একটি জনাকীর্ণ জেলে রাখা হয়েছে তাঁকে।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, সেনাবাহিনী ও দেশটির সরকার চক্রান্ত করে তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেছে। আর এখন গ্রেপ্তার করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাইছে। যদিও ইমরান তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর আইনজীবীরাও আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। এরইমধ্যে গতকাল মঙ্গলবার পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচন করতে পারবেন না ইমরান।
উল্লেখ্য, গত বছরের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা হারালেও এখনও পাকিস্তানজুড়ে বেশ জনপ্রিয় ইমরান। মসনদ থেকে নামার পরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তিনি দেশব্যাপী সমাবেশে হাজার হাজার লোককে আকৃষ্ট করেছিলেন যার কারণে পাকিস্তানে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এর আগে ইমরান যখন গ্রেপ্তার হন তখন পাকিস্তানজুড়ে তাণ্ডব চালান তাঁর সমর্থকরা। এরপর সেনাবাহিনী ব্যাপক ধরপাকড়ের মুখে দল থেকে পদত্যাগ করতে থাকেন ইমরানের সহযোগীরা। তবে এবারের গ্রেপ্তারের পর ইমরানের সমর্থদের রাস্তায় দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইমরান ও তাঁর সমর্থকদের প্রতি স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। এ নিয়ে ইসলামাবাদের কলামিস্ট আরিফা নুর বলেন, ধরপাকড়ের কারণে মানুষজন ভয়ে আছে। জনগণের প্রতিবাদকে দমানোর উপায় জানা আছে রাষ্ট্রের।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন বলছে, ইমরানকে এমন কারাগারে রাখা হয়েছে যা জঙ্গিদের জন্য ব্যবহৃত হয়। ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছে পাকিস্তান। দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রীই ৭৬ বছরের মধ্যে একবারও পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেননি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি পাকিস্তানের জনসংখ্যার অনেকাংশকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ২২ কোটি জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তানে প্রায়ই জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এছাড়া দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থাও এখন বিপর্যস্ত।
ইমরান খানের বর্ণাঢ্য জীবন :
ইমরান ১৯৫২ সালের লাহোরে একটি অভিজাত পরিবারে জন্ম নেন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি করেন। ইমরানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জেতে। এর দু বছর পর ইমরান তাঁর মায়ের নামে একটি ক্যানসার হাসপাতাল চালু করেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মা ১৯৮৫ সাল ক্যানসারেই আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
তরুণ বয়সে প্লেবয় জীবনযাপন করা ইমরানের প্রথম স্ত্রী ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক জেমিমা গোল্ডস্মিথ। স্ত্রী ও সন্তানসহ বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দেখা যায় ইমরানকে। পাকিস্তানে ইমরানের প্রভাব বাড়তে শুরু করলে তিনি ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান-ই-তেহরিক ইনসাফ (পিটআই) প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি ২০০২ সালের নির্বাচনে একটি আসন পায়। এরপর ইমরানের ভোল পাল্টাতে থাকে। প্লেবয় চরিত্র থেকে ধর্মীয় বক্তব্য দিয়ে লোকজনকে আকৃষ্ট করতে থাকেন। ইমরানের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ে ২০১৪ সালে। ওই সময় ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে পিএমএল-এনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে পিটিআই।
নতুন পাকিস্তান গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৮ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান। তাঁর আমলে করোনা মহামারির সঙ্গে পাকিস্তানজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এসময় দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে।
ইমরান ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সংঘাত হয়। তাঁর পুরো শাসনামলেই ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বৈরি সম্পর্ক ছিল। তবে করোনা ভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশংসিত হন পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান। বৈশ্বিক মহামারি শুরুর পরই তিনি সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে দেশজুড়ে লকডাউন জারি করে।
২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসলে তাদের পক্ষে বক্তব্য দেন ইমরান। আফগানিস্তানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন তিনি। সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরানের বিরোধ বাড়তে থাকার সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন।
কলামিস্ট নুর বলেন, প্রাদেশিক পর্যায়ে পরিবর্তন আনতে পারলেও জাতীয় পর্যায়ে তেমন পরিবর্তন আনতে পারেনি ইমরানের সরকার। ক্ষমতায় আসার পর ইমরানের রাজনৈতিক ইচ্ছা যথেষ্ট শক্তি শালী ছিল না যেমনটি আমরা আগে দেখেছি। আর এটি দিয়ে দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান গড়াতো দূরের কথা।
ক্ষমতা হারানোর পর পাকিস্তানের বর্তমান সরকার, যুক্তরাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর দিকে অভিযোগে আঙুল তোলেন ইমরান। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, খান সমর্থন জোগাড় করার জন্য কয়েক দশকের শত্রুতা নিয়ে খেলছিলেন।
গত মে-তে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গ্রেপ্তার হওয়ার পর পাকিস্তানজুড়ে তাণ্ডব চালান ইমরানের সমর্থকরা। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ইমরানের সমর্থকদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়ে শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। এরপর পাকিস্তানজুড়ে ধরপাকড় শুরু করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।
শনিবার গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ৭০ বছর বয়সী ইমরান। সেই সঙ্গে সমর্থকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তবে এবার আর ইমরানের সমর্থকদের তেমন রাস্তায় দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে ইমরানের সমর্থকরা বলছেন, পিটিআইর চেয়ারম্যানের তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় কারাদণ্ড রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পিটিআই মুখপাত্র সৈয়দ জুলফিকার বুখারি বলেন, ইমরানের আইনজীবীদের কোনো প্রমাণ বা যুক্তি দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
ইমরানের গ্রেপ্তারের দিনই পাকিস্তান সরকার জানায়, নতুন আদম শুমারির পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে, এ কারণে পাকিস্তানের নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জানা, শিগগিরই পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ভেঙে দেওয়া হবে। এরমধ্যে দেশটিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে নভেম্বরে তারা সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করবে।
তবে পরিস্থিতি বিবেচনা ইমরানের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেখছেন না বিশ্লেষকরা। এ নিয়ে কলামিস্ট নুর বলেন, রাজনীতিতে ইমরান খানের গল্প পাকিস্তানের যেকোনো রাজনীতিকের প্রতীক। পাকিস্তানের ইতিহাসে দেখা গেছে, যারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন তাঁরা পরে আরও জনপ্রিয় হয়েছেন। জনগণের সমর্থন উপভোগ করা সমস্ত রাজনীতিবিদরা পাকিস্তানের ক্ষমতায় ফিরেছেন।
পার্বত্য কন্ঠ নিউজ/রনি