গত বছর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বেশ সতর্কতার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। সংঘাত অবসানের চেষ্টায় কিয়েভ ও মস্কোকে এক টেবিলে বসানোর পাশাপাশি কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার শস্যচুক্তি স্বাক্ষর এবং তা নবায়নে অবদান রাখেন তিনি।
কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পর অনেকটা আকস্মিকভাবেই যেন সেই সম্পর্কের ইতি টানলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। প্রায় এক বছর ধরে যে সুইডেনকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোয় যোগদানের বিষয়টি আটকে রেখেছিলেন, চলতি সপ্তাহে হঠাৎ করেই সেই সুইডেনকে জোটের সদস্য করার ব্যাপারে রাজি হয়ে গেলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হঠাৎ রাজি হয়ে যাওয়ার পেছনে এরদোয়ানের নিশ্চিতভাবেই একটি উদ্দেশ্য রয়েছে, যেটা তিনি রীতিমতো ঘোষণা করেই জানিয়েছেন।
গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য করার বিষয়টি ঝুলে রয়েছে, যা সুরাহা করার জন্য গত দুই দশক ধরে ইইউ নেতাদের কাছে বারবার ধরনা দিয়েছেন এরদোয়ান। কিন্তু প্রতিবারই তাকে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে। এবার দাবি আদায়ের মোক্ষম সুযোগ পেয়েছেন এরদোয়ান। আর সেই সুযোগে পশ্চিমা নেতাদের কাছে জানিয়েছেন তুরস্কের ইইউ’তে যোগ দেয়ার আগ্রহের কথা।
বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই রুশ নেতা পুতিনকে ক্ষুব্ধ করবে। এখানেই শেষ নয়, এর আগে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ইস্তাম্বুলে আমন্ত্রণ জানান এরদোয়ান। জেলেনস্কির ইস্তাম্বুল সফরে তিনি ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদানের ব্যাপারে সমর্থন জানান। বলেন,
ন্যাটোর সদস্য হওয়া ইউক্রেনের অধিকার।
শুধু তাই নয়, তুরস্ক থেকে ইউক্রেনের সাবেক পাঁচ কমান্ডারকে দেশে ফেরান জেলেনস্কি। সাবেক এ কমান্ডাররা ইউক্রেনের মারিউপোল সেনাশিবিরে (গ্যারিসন) কর্মরত ছিলেন। রুশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর বন্দি হিসেবে তাদের তুরস্কে পাঠানো হয়েছিল।
ইউক্রেনের সাবেক এই পাঁচ কমান্ডারকে দেশে ফিরিয়ে আনার ঘটনাটিকে কিয়েভের জন্য একটি বড় ধরনের প্রতীকী অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইউক্রেনের সাবেক পাঁচ কমান্ডারের মুক্তির নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া বলেছে, এ ঘটনা গত বছর হওয়া বন্দিবিনিময় চুক্তির লঙ্ঘন।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় এসব ব্যক্তিকে তুরস্কে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আঙ্কারা। ইউক্রেনের সাবেক পাঁচ কমান্ডারকে মুক্তি দেয়ার বিষয়টি মস্কোকে জানানো হয়নি বলেও অভিযোগ করেছে রাশিয়া।
রাশিয়ার আরআইএ বার্তা সংস্থাকে পেসকভ বলেন,
ইউক্রেনীয় সাবেক কমান্ডারদের ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে কেউ মস্কোকে অবহিত করেনি। চুক্তি অনুসারে, এই কমান্ডারদের যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুরস্কে থাকার কথা ছিল।
এরদোয়ানের এই আঘাত এমন সময়ে এলো যখন সবেমাত্র ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনারের ব্যর্থ বিদ্রোহ থেকে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন পুতিন। বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, পুতিনের ক্ষমতার খুঁটি তা অনেকটাই নাড়িয়ে দিয়ে গেছে।
আর সম্ভবত এ বিষয়টিই পুতিনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে এরদোয়ানকে বাধ্য করেছে এবং ন্যাটোর অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে সেই পশ্চিমাদের সঙ্গেই গাটছড়া বাধলেন এরদোয়ান।
ইউক্রেন যুদ্ধকালে পুতিন ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে এরদোয়ান যা কিছুই করেছেন, সেটা সম্ভবত নানামুখী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেই, যেটা তিনি এখন থেকে ৭ বছর আগে তুরস্কে বিরোধীদের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পরই শুরু করেন। যেমনটা বলছেন সুইডেনে তুরস্কের সাবেক রাষ্ট্রদূত সেলিম কুনেরাল্প।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ডেইলি বিস্টকে এক সাক্ষাৎকারে কুনেরাল্প বলেন, এরদোগান সম্ভবত এটিকে আর পুতিনের শক্তির চিহ্ন হিসেবে দেখছেন না। বরং তার বিপরীতটাই দেখছেন তিনি।
কুনেরাল্পের কথায়, ‘তিনি (এরদোয়ান) হয়তো মনে করছেন যে, পুতিনের কাছ থেকে যা পাওয়ার তার সবকিছুই পেয়ে গেছেন। পুতিন আগের চেয়ে দুর্বল অবস্থানে আছেন। তিনি সম্ভবত তুরস্কের অর্থনীতিতে তেমন কোনো অবদান রাখার মতো খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। এজন্যই হয়তো অন্যদিকে নজর দিচ্ছেন এরদোয়ান।’
পার্বত্যকন্ঠ নিউজ/এমএস