• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২০ পূর্বাহ্ন

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে ওসি মিজানের প্রতিদিন ৫/৬ লাখ টাকা চাঁদাবাজি

ডেস্ক রিপোর্ট / ৫৭০ জন পড়েছেন
প্রকাশিত : সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

ডেস্ক রিপোর্টঃ

আলম তালুকদার নামে এক যুবলীগ নেতাকে থানায় এনে মারধরের ঘটনায় গত মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) সাময়িক বরখাস্ত করা হয় নেত্রকোনার দুর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুর রহমানকে। পরে বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) তাকে বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। বদলির পর থেকে ওই এলাকার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে হাট-বাজার সবখানে আলোচিত হচ্ছে দুর্গাপুর থানার ওসি মিজানের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র।

এলাকাবাসী বলছেন, মাত্র দেড় বছরে এই থানার অন্তর্গত বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদাবাজি করে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। প্রতিদিন তার নামে চাঁদা আদায় হতো ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। বালুমহাল, চোরাকারবারি থেকে শুরু করে যৌনকর্মী কোথাও চাঁদাবাজি বাকি রাখেননি তিনি। তাকে প্রত্যাহার করা হলেও তার চাঁদা তোলার সাগরেদরা এ থানায় এখনও রয়েছে বহাল তবিয়তে। এদের মধ্যে যুবলীগের কয়েকজন নেতা, পুলিশের অন্য সদস্য এমনকি স্থানীয় দালালরাও রয়েছে। আর সূত্রের খবর, এই ওসিও কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে খুঁজছেন বরিশাল রেঞ্জে কোনও বড় থানা।

ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ঝুমা তালুকদার অভিযোগ করেন, ‘সাবেক ওসি মিজান গত দেড় বছরে দুর্গাপুরের এমন কোনও সেক্টর নেই, যেখান থেকে চাঁদাবাজি করেননি। স্থানীয় এক যুবলীগ নেতার সহায়তায় ওসি মিজান দাপটের সঙ্গে সব অপকর্ম করে গেছেন। শুধু আলম তালুকদারকে মারধর করার ঘটনাই নয়, ওসি এলাকার অনেক নিরীহ যুবককে থানায় এনে মারধর ও নির্যাতন করেছেন।এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলার এক যুবলীগ নেতা এবং উপজেলা জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন, প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা চাঁদার একটি তালিকা রয়েছে ওসি মিজানের নামে। এই তালিকা ধরে প্রতিদিন চাঁদার ভাগ বুঝে নিতেন তিনি। প্রতিদিন তার নামে যে সব খাত থেকে চাঁদা আসতো সেগুলো হচ্ছে—বিরিশিরি বালু ঘাট থেকে প্রতি ট্রাকে ৭০ টাকা করে (প্রতিদিন ২৫০টি ট্রাক থেকে তার নামে এ চাঁদা ওঠাতেন তার নিয়োগ করা লোক), কানিয়াল ঘাট থেকে ট্রাক প্রতি ৫০ টাকা (প্রতিদিন ২০০টি ট্রাক থেকে এ চাঁদা ওঠানো হতো), দুর্গাপুর বালু ঘাট থেকে প্রতি ট্রাকে ৫০ টাকা (প্রতিদিন ৩০০টি ট্রাক থেকে এ চাঁদা ওঠানো হতো), বিরিশিরি স্কুল মাঠে ট্রাক প্রতি ৫০ ট্রাকা (প্রতিদিন ৩/৪শ’টি ট্রাক থেকে এ চাঁদা ওঠানো হতো )।

একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে ওসি মিজান এমন অপরাধ করলেও তার প্রতিবাদ করার সাহস পেতো না স্থানীয়রা। বিষয়গুলো অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানলেও ওসিকে কেউ ঘাঁটায়নি। বরং সরকারদলীয় কিছু সুবিধাভোগী ওসির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এর বখরায় ভাগ বসিয়েছে।

ঢাকায় রেজিস্ট্রেশন করা একটি ট্রাকের চালক মোজ্জাম্মেল হক বলেন, দুর্গাপুর উপজেলায় ঢুকলেই প্রথমে আমদানি রফতানির জন্য দিতে হয় ২শ’ টাকা, পৌরসভার জন্য ২শ’ টাকা, মালিক সমিতির জন্য ২শ’ টাকা, শ্রমিক ফেডারেশনের জন্য আগে নিতো ৩শ’ টাকা এখন করোনার জন্য নেয় ২শ’ টাকা। এতো বেশি টাকা নেওয়ার ঘটনা আর কোথাও নেই। এটা নিশ্চয়ই স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই নেওয়া হয়। না হলে এর বিরুদ্ধে কেন প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় না?

অপর একটি সূত্র দিয়েছে ওসি মিজানের চাঁদাবাজির আরও হিসাব। সূত্রটি জানায়, আত্রাইখালি ডাইভারশন থেকে ওসি মিজান নিতেন প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা। ট্রাক মালিক সমিতির নামে প্রতিদিন বিভিন্ন স্পটে যে চাঁদা তোলা হয় সেখান থেকে বখরা হিসেবে ওসি নিতেন দৈনিক ১০ হাজার টাকা। পৌর টোল আদায় থেকে নিতেন প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা।

উপজেলা ট্রাক মালিক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত যুবলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা টাকা তুলে খরচ বাদে টাকা জেলা কমিটির কাছে পাঠাই পরে তারাই স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে।

সূত্রটি আরও জানায়, প্রতি মাসে স্থানীয় মদের দোকান থেকে ১৮ হাজার টাকা, ভারতীয় গরু চোরাচালানের লাইনম্যান জালালের কাছ থেকে গরু প্রতি ৩শ’ টাকা করে নিতেন ওসি মিজান। সোমেশ্বরী নদী থেকে যে কয়লা তোলা হয় সেখানেও ওসি বসিয়েছিলেন তার ভাগ। প্রতি বস্তায় ১৫ টাকা করে দিতে হতো তাকে। এসব তো আছেই, স্থানীয় এক যৌনকর্মীও তার চাঁদাবাজির তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। প্রতি মাসে এই নারীকে দিতে হতো ১৫ হাজার টাকা। সে টাকা ওসি অবশ্য সরাসরি এসে নিতেন না লোকলজ্জার ভয়ে, তার হয়ে এ টাকা আদায় করতো ওসির বডিগার্ড জুয়েল।

উপজেলার যত দুই নম্বরী বা আইনে নিষিদ্ধ ব্যবসা-বাণিজ্য আছে সেগুলো বন্ধ না করে কিংবা যেগুলোর বিষয়ে সরকার ট্যাক্স পেতে পারতো সেগুলোতে সরকারের আয়ের পথ বন্ধ রেখে নিজে দু হাত ভরে কামিয়ে নিয়েছেন ওসি মিজান। স্বাভাবিক নিয়মেই এর কিছু ভাগ গেছে তার হয়ে চাঁদাবাজির ব্যবসা দেখভাল করা রাজনৈতিক নেতা, দালাল, তার সঙ্গে থাকা বডিগার্ড, থানার অন্যান্য পুলিশদের পকেটে। আর পুলিশ মহলেই অভিযোগ রয়েছে, এর ভাগ যেতো ময়মনসিংহ রেঞ্জের এক শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে, সব থানার ওসির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তার হাতে। তবে এ তথ্য প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।

নেত্রকোনার সীমান্ত পথে ভারত থেকে অবৈধভাবে আনা হতো প্রসাধন সামগ্রী। স্থানীয় প্রসাধন ব্যবসায়ীরা বৈধ আমদানির আড়ালে অবৈধ পথে যেসব প্রসাধন সামগ্রী আমদানি করতেন তার সব খবরই ছিল ওসি মিজানের কাছে। এ বিষয়ে অভিযান পরিচালনা না করে উল্টো এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন ওসি। এর বিনিময়ে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে মাসোহারা দেওয়া হতো ওসিকে। ওই তালিকায় এসব সূত্রের কথা উল্লেখ আছে এবং এসব তথ্য একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও অবহিত। আরও জানা গেছে, এসব কাজের অন্যতম সহযোগী ছিলেন ওসির বডিগার্ড কনস্টেবল জুয়েল।

কনস্টেবল জুয়েল মিয়া ওসির নির্দেশে চাঁদাবাজি করেছেন কিনা জানতে চাওয়া হলে জুয়েল বলেন, ‘আসলে কী আর করা যাবে।’ এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন।’

দুর্গাপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সুপারি চোরাচালানের মাধ্যমে আনার জন্য ওসি মিজানের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন স্থানীয় তোফাজ্জাল নামে এক ব্যক্তি। তার দাবি, এ কাজে সহায়তার জন্য ওসিকে বছরে এক লাখ টাকা দিতেন তিনি। কীভাবে ওসিকে টাকা দিতেন জানতে চাইলে তোফাজ্জাল বলেন, ‘আমি কারও মাধ্যমে টাকা দিতাম না, সরাসরি নিজ হাতে মিজান স্যারকে টাকা দিয়ে আসতাম।’

এছাড়া বিজয়পুর ও শিবগঞ্জ বর্ডার দিয়ে ভারতীয় চোরাচালান হতো, সেখান থেকে স্থানীয়ভাবে টাকা সংগ্রহ করতেন স্থানীয় সুরুজ আলী। সুরুজ বলেন, ‘ওসি স্যার আমাকে বলেন, তুমি জুয়েলের (ওসির বডিগার্ড) সঙ্গে লেনদেন করবা। আমি জুয়েল স্যারের সঙ্গে লেনদেন করতাম। ভারতীয় কসমেটিকস এবং অন্যান্য সামগ্রী এই লাইনে চলতো, আমি নিয়মিত মাসিক ১৪ হাজার টাকা দিতাম।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে দুর্গাপুর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমানের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে শনি ও রবিবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

দীর্ঘদিন ওসি মিজান দুর্গাপুর থানায় একচ্ছত্র চাদাঁবাজি চালিয়ে এসেছেন—এমন অভিযোগের বিষয়ে নেত্রকোনা পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সি বলেন, ‘আমরা এ ধরনের কোনও অভিযোগ পাইনি। পেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

উল্লেখ্য, গত ৯ অক্টোবর ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য আলম তালুকদারকে থানায় নিয়ে মারধর করেন ওসি মিজান। পরে ১০ অক্টোবর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন নেত্রকোনা পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সি। এ সময় প্রাথমিকভাবে ওসির কিছু কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় তাকে দুর্গাপুর থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। বর্তমানে ওসি মিজান বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত রয়েছেন। এছাড়া ওসির অপর দুই সহযোগী উপপরিদর্শক (এসআই) হালিম ও দেহরক্ষী কনস্টেবল মো. জুয়েলকে নেত্রকোনার দুটি পুলিশ স্টেশনে বদলি করা হয়েছে। এ ঘটনায় ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

দুর্গাপুর থানার নতুন যোগদানকৃত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ নুর আলম বলেন, আগের কোনও কিছু আমি জানি না। তবে বর্তমানে এই থানায় কোনও টাকা পয়সার লেনদেন হবে না। মামলা রুজু করতে, জিডি করতে কোনও টাকা পয়সা লাগবে না। এছাড়া সীমান্ত বা থানা এলাকায় কোনও অপরাধ, চাঁদাবাজি, চোরাচালান কাউকে করতে দেওয়া হবে না, মাদক ও সকল অপরাধে বিষয় পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে অবস্থান করছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ