বাংলাদেশের উপজাতি নৃ-গোষ্ঠির গারোদের নিজস্ব সাংস্কৃতি ও কৃষ্টির অন্যতম উৎসব হলো নবান্ন বা ওয়ানগালা উৎসব।
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর মরিয়মনগর সাধু জর্জ ধর্মপল্লীর গির্জা চত্তরে রবিবার (২১ নভেম্বর) দিনব্যাপী এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। সকাল নয়টায় থক্কা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সূচনা করেন মরিয়মনগর সাধু জর্জ ধর্মপল্লীরপালপুরোহিত ও খামাল ফাদার বিপুল ডেভিড দাস সিএসসি। উৎসবে ক্রুশচত্বরে বাণী পাঠ, খামালকে খুথুব ও থক্কা প্রদান, জনগণকে থক্কা দেয়া, পবিত্র খ্রীষ্টযাগ, দান সংগ্রহ, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গারোদের নিজস্ব ভাষায় গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়।
ওয়ানগালা হচ্ছে গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ফসল তোলার উৎসব যা তারা প্রতিবছর পালন করে । সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে নতুন খাদ্যশস্য ভোজন নিষেধ থাকে এ সম্প্রদায়ের জন্যে। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকেন। আবার ওয়াানগালা উৎসব একশ ঢোলের উৎসব নামেও পরিচিত।
গারোদের বিশ্বাস, ‘মিসি সালজং’ বা শস্য দেবতার ওপর নির্ভর করে ফসলের ভালো ফলন। নতুন ফল ও ফসল ঘরে উঠবে। তার আগে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে শস্যদেবতার প্রতি। গারো সম্প্রদায়ের এটাই চল। তাই শস্যদেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ও নতুন ফসল খাওয়ার অনুমতির জন্যে নেচে-গেয়ে উদযাপন করা হয় ঐতিহ্যবাহী ওয়ানগালা উৎসব। একই সঙ্গে পরিবারে ভালবাসা, মন্ডলীর আনন্দ, সব পরিবারের মঙ্গল কামনা করা হয় শস্য দেবতার কাছে।
দিনব্যাপী মরিয়মনগর সাধু জর্জ ধর্মপল্লীর গির্জা চত্তরে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শেরপুর জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আল মাসুদ, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জয়নাল আবেদীন, ঝিনাইগাতী থানার ওসি মোহাম্মদ ফায়েজুর রহমান ও এক্সাসাইজ ও ভ্যাট বিভাগের উপ-কমিশনার ওবিভাগীয় কর্মকর্তা মি. সুশান্ত পাল। মরিয়মনগর ধর্মপল্লীর পালপুরোহিত ও খামাল ফাদার বিপুল ডেভিড দাস সিএসসি জানান, সুপ্রাচীনকাল থেকে গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে নতুনপ্রজন্ম ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরাই এই ওয়ানগালা উৎসবে মূল লক্ষ্য।এক সময় গারো পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ হতো এবং বছরে মাত্র একটি ফসল হতো। তখন ওই জুম বা ধান ঘরে উঠানোর সময় গারোদের শস্য দেবতা ‘মিসি সালজং’ কে উৎসর্গ করে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। কারন হিসেবে জানাগেছে, গারোদের ওই শস্য দেবতা এক সময় পাহাড়ি এলাকার গারোদের হাতে কিছু শস্য দিয়ে বলেছিল, ‘তোমরা এটা রোপন কর তাতে তোমাদের আহারের সংস্থান হবে এবং তোমরা যে শস্য পাবে তা থেকে সামান্য কিছু শস্য আমার নামে উৎসর্গ করবে।’এরপর থেকেই গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছে।খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গারোরা তাদের ঐতিহ্যবাহি সামাজিক এই প্রথাটিকে এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে পালন করে থাকেন । অর্থাৎ এক সময় তারা তাদের শস্য দেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিষ্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন।
এসময় সামাজিক নানা আয়োজনসহ ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানাদিও পালন করা হয়।শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী মরিয়মনগর সাধু জর্জ ধর্মপল্লীর নিয়ন্ত্রনে জেলার সদর উপজেলাসহ শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী এবং জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার গারো সমাজের ৪৭ টি গ্রাম রয়েছে। এইসব গ্রমের প্রায় ২২ হাজার খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বি গারো সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস।মরিয়ম নগরের ওয়ানগালা উৎসবটি এবার ৩৬ বছরে পা দিয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে এখানে ওয়ানগালা উৎসব পালন করা হচ্ছে। ফলে এবার গারোদের মাঝে উৎসবের আমেজটা অন্যবারের চেয়ে অনেক বেশী। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য খ্রিষ্টভক্ত এবং গারাগানজিং, কতচু, রুগা, মমিন, বাবিল, দোয়াল, মাতচি, মিগাম, চিবক, আচদং, মাতাবেং ও আরেং নামে ১২ টি গোত্রের গারো সম্প্রদায়ের লোকজন এবার ওয়ানগালা উৎসবে উপস্থিত হয়েছেন। এদিকে ওয়ানগালা উৎসব উপলক্ষ্যে ধর্মপল্লীর পাশে বসেছিল জমজমাট মেলা। মেলায় গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকসহ শিশুদের নানা রকমের খেলনা বিক্রি করা হয়। ফলে এখানে গারো শিশু ও যুবক-যুবতিরা বিভিন্ন পসড়ার দোকানে তাদের পছন্দের জিনিস কিনতে ভিড় জমান। ওয়ানগালা উৎসবে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা গারো সম্প্রদায়ের লোকজন এবং তাদের আত্মিয়রা একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা সাক্ষাত হওয়ায় তারা অনেকটা বড় দিনের উৎসবের মতো আনন্দ উপভোগ করেন।