ছোটন বিশ্বাস, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি।। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব মাতৃভাষা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিদেশীয় ভাষার চর্চা করতে গিয়ে নিজেদের মাতৃভাষা ভূলতে বসেছে। তাই খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষা রক্ষার্থে সিন্দুকছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ভাষা শিখন কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বিলুপ্তপ্রায় ভাষাসমূহ সংরক্ষণ ও ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সিন্দুকছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভাষা শিখন কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ভাষা শিক্ষার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকবৃন্দ বর্তমানে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে সপ্তাহে ১ দিন সোমবার এ শিক্ষার্থীদের মারমা ও ত্রিপুরা ভাষা শিক্ষায় পাঠদান দিয়ে যাচ্ছেন।
ভাষা শিখন কেন্দ্রটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ৬মাস ব্যাপি কোর্স প্ল্যান ডিজাইন করা হয়েছে। এবং প্রতিটি কোর্চ এ ৩০ জন মারমা ও ৩০ জন ত্রিপুরা শিক্ষার্থী তাদের নিজস্ব ভাষা সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করছে। কোর্চটির দক্ষতা অর্জনের পরে শিক্ষার্থীদের সনদ বিতরণ করা হবে।
যা চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সনদের গ্রহণযোগ্যতা কাজে আসবে বলে জানান প্রশাসন।
গত ১ অক্টোবর ২০২৪ ইং এ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ভাষা শিখন কেন্দ্রের চলমান কার্যক্রমের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মোঃ সহিদুজ্জামান। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল।
পরিচালিত শিক্ষাকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাষা শিখন কেন্দ্রে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সাথে নিজেদের ভাষা পড়ছে ও শিখছে।
ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষার্থী হৈমন্তী ত্রিপুরা ও বিজয় মারমা জানান, মূল পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি নিজেদের মাতৃভাষা (লিখা ও পড়া) জ্ঞান সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করতে পেরে অনেক খুশি। আমরা আগে আমাদের যে ভাষা সেটা ভালো করে উচ্চারণ ও লিখতে জানতাম না। এভাষা শিক্ষা কেন্দ্রে এসে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। গাণিতিক সংখ্যা থেকে শুরু করে নিজস্ব ভাষার বর্ণমালা, দিনের নাম, বছরের নাম, যোগ বিয়োগ করতে পারি। আশা করি সামনে আরো অনেক কিছু শিখতে পারবো।
শিক্ষক অনন্ত বিকাশ জানান, আমি বুদং পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে আমার মাতৃভাষার উপর ১২ দিনের একটি ভাষা প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ দানের পাশাপাশি এই ভাষা কেন্দ্রে নিজস্ব মাতৃভাষার উপর পাঠ দান দিয়ে যাচ্ছি। মূল পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি নিজেদের মাতৃভাষা জ্ঞান সম্পর্কে দক্ষতা অর্জনের জন্য সপ্তাহে ১দিন সময় দিয়ে থাকি। আমি মনে করি, যদি নিজের মাতৃভাষা ভালো করে না বুঝলে বিদেশি ভাষাও ভালো করে শিখা সম্ভব না। তাই জেলার প্রতিটি উপজেলায় এ ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র চালু করা হলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি অন্যান্য ভাষাও তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে ।
খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব চৌধুরী জানান, মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় “পৃথিবীর কোন ভাষাই হারিয়ে যাবে না” এই শ্লোগানকে সামনে রেখেই উপজেলা প্রশাসন, গুইমারা উদ্যোগে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দুর্গম সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নে স্থাপন করেছে “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ভাষা শিখন কেন্দ্র। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় কথা বলার অধিকার রয়েছে। যাতে কোনো ভাষাই হারিয়ে না যায়, এমনটি উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন তিনি।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রসাশক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, গুইমারা উপজেলা প্রশাসনের ভাষা রক্ষার্থে এরকম উদ্যোগকে সাদুবাদ জানান। এবং বলেন, এই ভাষা শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে নিজস্ব মাতৃভাষা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন, ভাষার লিখিত রূপ, উচ্চারণ এবং বিলুপ্তপ্রায় ভাষাসমূহ সংরক্ষণ ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
প্রত্যেক জনগোষ্ঠী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো ভাষা। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা সংরক্ষণে সরকারের এ শুভ উদ্যোগকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেছে এবং সাধুবাদ জানিয়েছে। পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি রক্ষা ও পাহাড়ে চলমান অস্থিরতা কমাতে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলা প্রশাসনের এমন উদ্যোগ সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন সুশীল নাগরিক সমাজ।