মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ব্যুরো প্রধান, বান্দরবান:
* অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কখনো নেয়া হয়নি আইনি ব্যবস্থা।
* অভিযোগের তীর রাস্তার পাশের জমির মালিকদের দিকে।
* ধ্বংস হচ্ছে লাখ লাখ টাকার বনজ সম্পদ।
সরকারি সড়কের দুই ধারের বড় বড় মূল্যবান গাছ বিভিন্ন কৌশলে মেরে ফেলা হচ্ছে। অনেকে বিভিন্ন অজুহাতে কেটে নিয়ে যাচ্ছে সড়ক বনায়নের অর্ধশতবর্ষী গাছ গুলো। নিজেদের সামান্য লাভের জন্য সরকারের লাখ লাখ টাকার গাছ নষ্টে জড়িত রয়েছেন সড়কের পাশের জমির মালিকরা। যে গাছ সড়কের পাশে সারিবদ্ধভাবে মাথা উঁচু করে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে, সেই গাছগুলো মেরে ফেলে এক দিকে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের লাখ লাখ টাকার বনজসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
বান্দরবান জেলার লামা-আলীকদম-চকরিয়া ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সড়কে গত ২০ বছরে কয়েক হাজার গাছ কৌশলে মেরে ফেলা হয়েছে। কেটে নেয়া হয়েছে লক্ষাধিক গাছ। গাছ মেরে ফেলা বা চুরি করে কেটে নেয়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কখনো আইনী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি সড়ক ও জনপদ বিভাগ বান্দরবান কার্যালয়কে। অনেকসময় এই গাছ কাটার সাথে খোদ সড়ক ও জনপদ বিভাগের লামা অফিসের ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বান্দরবান সড়ক ও জনপথ বিভাগের লামা-আলীকদম-চকরিয়া সড়ক এবং এলজিইডি লামার লামা-সুয়ালক সড়কের দুই ধারে সরকারিভাবে লাগানো সারিবদ্ধ বড় বড় মেহগনি, কড়ই, একাশি, ইউক্লিপটার্স, আকাশমনি, আম, কাঁঠাল, নিম, অর্জুন সহ বিভিন্ন জাতীয় গাছগুলো বিভিন্ন উপায়ে মেরে ফেলার নানা চেষ্টা চলছে। জমির মালিকরা রাতের অন্ধকারে গাছের গোড়ায় আগুন ধরিয়ে বা গাছের গোড়া গোল করে ছাল তুলে রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করছেন। ফলে গাছগুলো ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। পরে দুর্বৃত্তরা এসব গাছের ডালপালা অল্প অল্প করে কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে। রাতের আঁধারে গাছের গুঁড়িও গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই লাখ লাখ টাকার মূল্যবান গাছ ধ্বংস করছে দুর্বৃত্তরা।
সোমবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে লামা-আলীকদম সড়কের রেপারপাড়া বাজারস্থ চৈক্ষ্যং উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দুইটি বড় বড় কড়ই (শিশু গাছ) গাছের গোড়া গোল করে ছাল তুলে রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে দেখা গেছে। আশপাশের লোকজন এ কাজ করেছে বলে জানা গেছে। লামা-আলীকদম-চকরিয়া সড়কের লাইনঝিরি হতে শিলেরতুয়া ৪ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশ এখন প্রায় গাছ শূণ্য হয়ে পড়েছে। কয়েকটি চোর সিন্ডিকেট এবং লাইনঝিরি, ছাগলখাইয়া ও হরিণঝিরি বাজারের দোকান মালিকরা সামনের সড়কে বেশ কিছু বড় গাছ কেটে নিয়ে গেছে। অনেকে গাছের গোড়ায় আবর্জনার স্তুপে আগুন দেয়ায় বেশ কিছু গাছের গোড়া পুড়ে গেছে ও তা কেটেও নিয়ে গেছে।
একইভাবে এলজিইডি লামার বাস্তবায়িত লামা-সুয়ালক সড়কের বেশিরভাগ গাছ এভাবেই মেরে ফেলা হচ্ছে। সড়কটির আন্ধারি এলাকা হতে সরই আমতলী এলাকা পর্যন্ত অসংখ্য গাছ কেটে নেয়া হয়েছে ও সাপমারাঝিরি এলাকায় কয়েকটি কড়ই গাছের গোড়া গোল করে ছাল তুলে ও আগুন দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা চলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার অনেকেই বলেন, রাস্তার পাশের গাছের কারণে পাশের জমিতে ছায়া ও পাতা পড়ে। যে কারণে ওই অংশে তেমন ফসল হয় না। রাস্তার পাশে সামনে গাছ পড়লে দোকান বা বসতবাড়ি করতে সমস্যা হচ্ছে। তাই জমির মালিকরাই কৌশলে গাছ মেরে ফেলছেন। এ ব্যাপারে ঝামেলা এড়াতে পাশের জমির মালিকরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে লামা সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা একেএম আতা এলাহি, তৈন রেঞ্জ কর্মকর্তা জুলফিকার আলী ও ডলুছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা একেএম রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আগুন দিয়ে বা গোল করে গাছের ছাল তুলে গাছ মেরে ফেলার মহোৎসব দীর্ঘদিন ধরে চলছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের করার কিছুই নেই। রাস্তার পাশের ওই গাছগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব আমাদের না। ওই গাছগুলো দেখভাল করে থাকে বান্দরবান সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং এলজিইডি লামা। তবে তারা আমাদের সহযোগিতা চাইলে নিতে পারে।’
তৈন রেঞ্জ কর্মকর্তা জুলফিকার আলী আরো বলেন, ‘সড়কের দু’পাশের গাছ বেশি নষ্ট করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বৈদ্যুতিক তারে লাগা গাছের ডাল কাটতে গিয়ে গাছের মাঝ থেকে কেটে ফেলছে। কাটা অংশ মানুষ নিয়ে যায় এবং বাকি অংশ টুকু শুকিয়ে মারা যায় বা মানুষ কেটে নিয়ে যায়। অথচ বিদ্যুৎ বিভাগ রাস্তার দায়িত্বে থাকা এলজিইডি বা সওজ বিভাগকে জানিয়ে গাছ কাটা দরকার। সংশ্লিষ্ট বিভাগ বন বিভাগের মাধ্যমে গাছের মূল্যনির্ধারণ করে নিলাম দিলে সরকার প্রচুর টাকা রাজস্ব পেত।
লামার সরই ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইদ্রিস কোম্পানি বলেন, ‘নানাভাবে সড়কের গাছ কাটা হচ্ছে। সড়কের পাশের গাছ গুলো অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে সড়কের উপর ঝুঁকে পড়া কিছু ঝুঁকিপূর্ণ গাছ অপসারণের জন্য এলজিইডি লামা অফিস নির্দেশনা দেয়। অনেকে আবার রাতের আঁধারে কেটে নিয়ে যাচ্ছে।’
বান্দরবান সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সড়ক উপ-বিভাগ-১) টোয়েন চাকমা বলেন, ‘চুরি করে গাছ কাটা লোকজনের বিরুদ্ধে লামা থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। আমাদের লোকবল সংকট আছে। মামলা গুলো তদারকী করতে না পারায় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। অনেকে রাস্তার গাছ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মেরে ফেলার বিষয়টি আমি শুনেছি। মরা গাছও রাস্তার পাশে দেখি। এগুলো করছেন রাস্তার পাশের জমির মালিকরা। এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগ কোন নিয়ম না মেনে যখন-তখন গাছ কাটছে। বিদ্যুৎ বিভাগ আমাদের থেকে কোন অনুমোদন নেয়না। বিষয়টি আমলে নেওয়া হবে।’
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর লামার উপজেলা প্রকৌশলী আবু হানিফ বলেন, সড়ক বনায়নের গাছ ধ্বংসের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শান্তনু কুমার দাশ বলেন, ‘আমি বিষয়টি শুনলাম। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে বিষয়টি জানিয়ে দেব। তারাই ব্যবস্থা নেবে।’