মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ব্যুরো প্রধান, (বান্দরবান)
বান্দরবান জেলার অন্যতম প্রাচীন প্রসিদ্ধ একটি বৌদ্ধ বিহার। এই বিহারকে কেন্দ্র করে এক সময় এঅঞ্চলে বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। বিহারের অধ্যক্ষ উপাইন্দা ওয়াইনসা মহাথেরো এর ভাষ্যমতে প্রায় ২০০ বছর আগে ১৮২০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এই বিহার স্থাপিত হয়। লামা উপজেলায় আরও ৩৫টি বৌদ্ধ বিহার থাকলেও এটি এঅঞ্চলের বোদ্ধধর্মালম্বীদের কাছে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। জায়গাটিতে ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ প্রাচীনত্ব এবং রয়েছে বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন। যার মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, মঠ এবং চৈতন্য-জাদি উল্লেখযোগ্য।
বান্দরবানের লামা উপজেলা সদর থেকে আলীকদম যাওয়ার রাস্তা ধরে তিন কিলোমিটার এগুলেই লাইনঝিরি। লাইনঝিরি বিএটিবি অফিস থেকে উত্তর দিকে আঁকা-বাঁকা রাস্তাই পাহাড়ি ধান ক্ষেতের বুক চিড়ে এক কিলোমিটার এগিয়ে গেলে সাবেক বিলছড়ি। অথবা লামা বাজার থেকে রূপসীপাড়া রাস্তার কলিঙ্গাবিল থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিনে গেলেই দেখা মিলবে সাবেক বিলছড়ি গ্রামের। সাবেক বিলছড়ি বিশাল বিলের সবুজ ধানক্ষেতের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত ২০০ বছরের পুরনো এই বৌদ্ধ বিহারটি। পূর্ব ও দক্ষিণ দুইপাশে মাতামুহুরী নদী আর পশ্চিম ও উত্তর পাশে চোখ জুড়ানো বিশাল বিল। এরই মাঝে ২শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বৌদ্ধ বিহার। প্রায় ১৫ একর সমতল ও পাহাড়ি জায়গার উপর নানা স্থাপনা এবং ভবন নির্মাণ করে বৌদ্ধ বিহারটি অবস্থিত।
বিহারের প্রবেশপথেই দেখা মিলবে থাঝাঙ প্যাঙখাইন, মুচলিন্ডা বা নাগ আসনে বৌদ্ধ। পানির উপর ভাসমান এই সুন্দর স্থাপনা বিহারে আগত দর্শনার্থীদের নজর কাড়ছে। বৌদ্ধভিক্ষুদের ভাষ্যমতে, ভগবান বুদ্ধ বোধি গাছের নিচে ধ্যান শুরু করার চার সপ্তাহ পরে আকাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সাত দিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। সর্পের রাজা নাগ বা মুচলিন্ডা পৃথিবীর তলদেশ থেকে উত্থিত হয়েছিলেন এবং বুদ্ধকে তাঁর কান্ড দিয়ে সুরক্ষিত রেখেছিলেন। ঝড়বৃষ্টি থামলে সর্পরাজ নাগ মুচলিন্ডা মানবরূপ ধারণ করে বুদ্ধের সামনে মাথা নত করেছিলেন। বৌদ্ধের এই লোককাহিনির উপস্থাপনা হচ্ছে নাগ বুদ্ধের মূর্তি, মুচলিন্ডা বা থাঝাঙ প্যাঙখাইন।
বৌদ্ধধর্মের প্রবারণা হলো আত্মশুদ্ধির ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণের অনুষ্ঠান। প্রবারণার অন্ধকার রাতে শত শত ফানুসের আলোয় ঝলমল করে মুচলিন্ডা বুদ্ধমূর্তি। এরপাশেই ছোট মাঠের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক বোধিবৃক্ষ। যার তলায় ধ্যান করে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ গৌতম বোধিলাভ করে বুদ্ধ হয়েছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় ‘বোধি’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’। ধর্মীয়মতে, বোধিবৃক্ষ তার হৃদয়াকৃতির পাতা দ্বারা সহজেই চেনা যায়। গৌতম বুদ্ধ পঁয়তিরিশ বছর বয়সে, বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে পূর্বদিকে মুখ করে সুজাতার দেওয়া পায়েসান্ন ঊনপঞ্চাশ গ্রাসে গ্রহণ করে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করার মানস নিয়ে যে অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন তাকেই বলা হয় বোধিদ্রুম বা বোধিবৃক্ষ। বৌদ্ধদের নিকট এই জাতীয় বৃক্ষই পরম ভক্তিতে বোধিবৃক্ষ হিসেবে পূজিত হয়। প্রতি বছর বৈশাখের শুরুতে এই গাছের নিচে সাংগ্রাই উপলক্ষে বসে তিনদিন ব্যাপী বৈশাখী মেলার। সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের ভিড় জমে এখানে।
তারপরেই সমতল জমিতে চারদিকে বাউন্ডারি দেয়া বিহারের মূল উপাসনালয় বা ক্যাং ঘর। পুরনো ক্যাং ভবনটি সেমিপাকা ও কাঠের। সেখানে দৌতলায় বৌদ্ধের মূর্তি। আগত বুদ্ধ ভক্তরা ওখানে পূজা, প্রদীপ প্রজ্বলন, সমবেত প্রার্থনা ও বুদ্ধ পূজা করে। এভবনের নিচতলায় তাদের বিশ্রামের জায়গা। নতুন তিনতলা ভবনটি পাঁকা। যদিও এখনো একতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ উপাইন্দা ওয়াইনসা মহাথেরো জানান পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর নতুন ভবনের বাকী দুইতলার কাজ দ্রুত শেষ করে দিবেন বলে কথা দিয়েছেন। পুরনো বিহার ভবন স্থানীয়দের চাঁদা ও দানের টাকা দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। যার পূর্বপাশ ঘেষে বেয়ে গেছে চিরচেনা প্রবাহমান মাতামুহুরী নদী।
বিহারের প্রবেশপথে পাহাড়ে ১৫০ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই আরেকটি বিহারের দেখা মিলবে। ভেতরে বুদ্ধের তিনটি রূপ-তিনটি মূর্তি। মাঝখানের তামার তৈরি মূর্তিটি প্রায় ১০৫ বছর আগে আনা হয়েছে মিয়ানমার থেকে। দুই পাশের মূর্তি দুইটি দেশেই তৈরি। বিহারের এই ভবনের দুইটি অংশ। পেছনের অংশে রয়েছে বুদ্ধের আরো কয়েকটি রূপ। ওখানে রয়েছে ২০ ফুট লম্বা সিংহ শয্যা গৌতমবুদ্ধ মূর্তি। এই বিহারের পাশে পাহাড়ের উপর রয়েছে মৃত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কবরসহ আরো বেশকিছু ছোট ছোট স্থাপনা। পাহাড়ের উপর দিয়ে কিছুটা দক্ষিণে হেঁটে সামনে এগুলে আরো একটি ভবন। এখানে রয়েছে এখানকার সবচেয়ে বড় প্রায় ৩০ ফুট উচুঁ মূর্তিটি। এটি দেশেই তৈরি। তবে কারিগর আনা হয় মিয়ানমার থেকে।
বিহারের অধ্যক্ষ উপাইন্দা ওয়াইনসা মহাথেরো আরো জানান, বছর দশেক আগে এই বিহারের দুইবার চুরির ঘটনা ঘটেছিল। বিহারের ৫শত রূপা, ব্রোঞ্জ ও তামার বৌদ্ধ মূর্তি ছিল। দুইবার চুরির ঘটনায় প্রায় ৪শত মূর্তি নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। শতাধিক মূর্তি আছে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও হারানো মূর্তি গুলো এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ঐতিহাসিক গুরত্ব এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ মন্দিরের গুরত্ব খুব বেশি। সংসার জীবনে শান্তি ও কল্যানের জন্য প্রতিদিন দূর-দুরান্ত থেকে পূজা দিতে অসংখ্য পূজারী এবং পর্যটক এখানে আসেন। কিন্তু যথাযথ পৃষ্টপোষকতার অভাবে বিহারটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। বিহারটিকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হলে এটি বান্দরবান জেলার সবচেয়ে সুন্দর পুরার্কীতি হিসাবে রূপলাভ করবে। পাশাপাশি দর্শনীয় স্থান হিসাবে পর্যটকদের কাছেও নতুন পরিচিতি পাবে।