লামার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা দেখল লামাবাসী। ৭ দিনের টানা বর্ষণে ৪দিন (৬ আগস্ট থেকে ৯ আগস্ট) পানির নিচে ছিল লামা উপজেলা দুই-তৃতীয়াংশ। স্থানীয়রা জানান, লামা উপজেলায় বিগতদিনে সবচেয়ে বড় বন্যা দেখা গিয়েছিল ১৯৮৭ ও ১৯৯৭ সালে। এবারের বন্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে। ১৯৮৭ সাথে বড় বন্যার চেয়ে এবার সাড়ে ৩ ফুট পানি বেশি উঠেছে। চার দিনের স্থায়ী বন্যায় সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয় ৭ আগস্ট সোমবার। ওইদিন মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১১.৯৬ সে:মি: এর উপর দিয়ে আরো ৬ ফুট উচু হয়ে পানি প্রবাহিত হয়।
লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, লামা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যায় প্রাথমিক হিসাবমতে ১ হাজার ঘরবাড়ি বিধস্ত হয়েছে, প্রায় ৩ হাজার ৫শত মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে, পানিবন্ধী হয়ে পড়েছিল প্রায় ২ হাজারে অধিক পরিবার। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় কোন চেয়ারম্যান মেম্বারদের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাত থেকে আপাতত ১৫ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য ১টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নে খাদ্যশস্য বিভাজন করে দেয়া হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ এখনো হিসাব করা যায়নি।
লামা পৌরসভার মেয়র মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, পৌর শহরের এমন কোন ব্যবসায়ী বা বাসিন্দা নাই যাদের বন্যা বা পাহাড় ধসে ক্ষতি হয়নি। দুর্গতের পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সরকারি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শীঘ্রই বানবাসী মানুষের সহযোগিতা করা হবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি।
লামা বাজারের ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান ডন, বাবুল কান্তি দাশ, মোঃ জহির, আবুল হোসেন সহ অনেকে বলেন, বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে যেখানে মালামাল রেখেছিলাম, সেখানে হানা দিয়েছে বন্যার পানি। কোনভাবে মালামাল বাঁচানো যায়নি। লামা বাজারের প্রতিটি ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে। বিসিএস সার ডিলার মোঃ নাছির বলেন, আমার তিনটি গুদামে কমপক্ষে ২ হাজার বস্তা সার পানিতে ভিজে গেছে। মুদি ব্যবসায়ী লিটন দাশ বলেন, আমার গুদামে ২০০ বস্তা চাল পানিতে ভিজে গেছে। মুদি মালের হিসাব নাই।
পৌর শহরের মত ৭টি ইউনিয়নে একইভাবে আঘাত হেনেছে বন্যা ও পাহাড়ধস। রুপসীপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মার্মা বলেন, আমার ইউনিয়নের এক হাজারের অধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্ধী ছিল অন্তত ২০ হাজার মানুষ। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় সকল ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গ্রামীণ সড়ক গুলো অধিকাংশ ভেঙ্গে গেছে। সেইসাথে বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।
জানা যায়, এবারের বন্যায় উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী বাজার পাড়া এলাকায় মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় আবুল হোসেনের স্ত্রী করিমা বেগম (৩৫) ঘরের মাটির দেয়াল চাপা গড়ে মারা গেছে এবং একই দিন দুপুরে রূপসীপাড়া ইউনিয়নের এক উপজাতি লোক নদী পার হতে গিয়ে ভেসে যাওয়ায় পানিতে ডুবে মারা গেছে। এছাড়া বাড়িতে গাছ ভেঙ্গে পড়ে বা পাহাড় ধসে ১৫ জনের অধিক লোক আহত হয়েছে। বন্যার পানি কিছুটা কমে যাওয়ায় লামা-আলীকদম-চকরিয়া সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে। তবে লামা-চকরিয়া সড়কের ইয়াংছা বেইলি ব্রিজ পাহাড়ি ঢলের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যানবাহন যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে।
লামা উপজেলা প্রকৌশলী কর্মকর্তা আবু হানিফ বলেন, টানা ৬/৭ দিনের বৃষ্টিতে ৪ দিনের স্থায়ী বন্যায় উপজেলার গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ একেবারে বিধস্ত হয়ে গেছে। কাঁচা পাঁকা রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। বেশকিছু ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক ধারনা মতে অবকাঠোমোগত ক্ষতি অর্ধশত কোটি টাকার অধিক।
লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ভয়াবহ বন্যার পানিতে হাসপাতালের এক তলা পানির নিচে ডুবে যায়। এতে করে এক্সরে, ইসিজি, আলট্রাসন্রোগাফি মেশিন, এয়ারকন্ডিশন, প্যাথলজি বিভাগ, জরুরি বিভাগ, প্রশাসনিক শাখা পানিতে সম্পূর্ণ ডুবে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়। হাসপাতালের ভর্তি রোগী ও প্রত্যেক্ষদর্শীরা জানায় কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে সরকারি মালামাল বাঁচানো সম্ভব হত। তাদের অবহেলায় কোটি টাকার সরকারি জিনিসপত্র পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে।
চার দিন ব্যাপী স্থায়ী বন্যার পানিতে লামা উপজেলার কমপক্ষে ২০টির অধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানিতে ডুবে গেছে। নুনারবিল সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহেদ সরোয়ার বলেন, স্কুলে এক তলা ডুবে দ্বিতীয় তলায় একফুট পানি হয়েছে। নিচতলার শ্রেণীকক্ষে থাকা তিনটি বড় এলইডি টিভি, ২০টির অধিক সিলিং ফ্যান, আইপিএস, ২টি ল্যাপটপ সহ বেশকিছু ফার্ণিচার নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, পানিতে ডুবে ২০টির অধিক স্কুলে বেশ ক্ষতি হয়েছে ক্ষয়ক্ষতির এখনো পরিমাপ করা যায়নি। এছাড়া লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সহ ৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা পানিতে ডুবে যায়।
এদিকে অকল্পনীয় বন্যায় লামা খাদ্য গুদামে সরকারি মজুদকৃত খাদ্যশস্যের মধ্যে ১৫০ মেট্রিক টন (৩ হাজার বস্তা) চাল পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে। লামা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম হেলালী বলেন, জেলা কর্মকর্তার নির্দেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার উপস্থিতিতে বন্যার পানিতে ভিজে যাওয়া চাল আলাদা করা হচ্ছে। বিষয়টি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে সরকারের এমন ক্ষতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোন প্রতিত্তোর দেননি।
আকস্মিক বন্যায় লামা উপজেলার অধিকাংশ সরকারি অফিস পানির নিচে ডুবে যায়। ভয়াবহ বন্যার পানিতে ডুবে যায়- লামা উপজেলা পরিষদ, লামা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, লামা থানা, সহকারী পুলিশ সুপার কার্যালয়, লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কৃষি অফিস, প্রাণীসম্পদ অফিস, খাদ্য গুদাম, সমাজসেবা অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী, উপজেলা নির্বাচন অফিস, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, জেলা তথ্য অফিস লামা, বিআরডিবি অফিস, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, গণপূর্ত অফিস।
লামা বিদ্যুৎ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, শতাধিক বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে গেছে, অসংখ্য স্থানে গাছ পড়ে তাঁর ছিঁড়ে গেছে। লামা সাব স্টেশনে ইয়াংছা সহ কয়েকটি ফিড চালু করা হয়েছে। অসংখ্য বিদ্যুতের লাইন ও মিটার এখনো পানির নিচে। লামা পৌরসভা, রূপসীপাড়া, গজালিয়া, লামা সদর ও বমু বিলছড়ি এলাকায় বিদ্যুৎ চালু করতে সময় লাগবে। আমাদের কর্মীরা বিরামহীন কাজ করছে। এদিকে গত ৪দিন যাবৎ বিদ্যুৎ না থাকায় মানুষ হাহাকার করছে। বিদ্যুৎ না থাকায় তার সাথে পাল্লা দিয়ে পালিয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক।
উপজেলা কৃষি অফিসার রতন কুমার বর্মন বলেন, অধিকাংশ আবাদী জমি ও ফসলের মাঠ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। সবধরনের ফসল ও শাক-সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যা ও বৃষ্টির অবস্থা উন্নতি না হলে কৃষিখাত চরম বিপর্যস্থ হবে। প্রচুর মজুদ সার নষ্ট হয়ে গেছে।
লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, বন্যার শুরুতে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে মাইকিং করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। পরে তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পানিবন্ধী লোকজনকে দিতে-রাতে উদ্ধার করতে অভিযান অব্যাহত ছিল। আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে ৪ শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। সাধ্যমতে তাদের শুকনো ও রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। এখন ১৫ মেট্রিকটন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরো বরাদ্দ আসবে।
লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল বলেন, বন্যার পানিতে পানিবন্ধী মানুষকে নৌকায় করে জনপ্রতিনিধিরা খাবার পৌঁছে দিয়েছে। অনেককে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। এতবড় বন্যার আঘাত ঘুছিয়ে উঠতে সময় লাগবে। সরকারি সহায়তা বাড়ানো খুবই জরুরি। এখনো বন্যার পানিতে নিম্নাঞ্চল ডুবে আছে ও বৃষ্টিও হচ্ছে। লামার বন্যার পরিস্থিতি নিয়ে পার্বত্য মন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।