বান্দরবানের লামার ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বরাদ্দের দুই অর্থবছরের ১৫০ মেট্রিক-টন খাদ্যশস্য আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০টি প্রকল্পের বিপরীতে ১০০ টন (৮০ টন চাল ও ২০ টন গম) এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৫টি প্রকল্পের অনুকূলে ৫০ টন খাদ্যশস্য কাজ না করেই লোপাট করা হয়েছে।
জানা যায়, বান্দরবান পার্বত্য জেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড এবং যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বরাদ্দ হতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পের অনুক‚লে ৫০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩০শে জুন ২০২৩ইং প্রকল্পের শতভাগ কাজ সম্পাদন হয়েছে মর্মে মাষ্টাররোল/সমন্বয় ভাউচার দাখিল করা হয়েছে। প্রকল্প গুলো হল, কাঁঠালছড়া রোড হতে মাঙ্গঝিরি ফরিদ মিস্ত্রির বাড়ি অভিমুখী রাস্তা সংষ্কার, লাইল্যারমার পাড়া রবিউলের দোকান হতে ডেসটিনি বাগান রাস্তা সংষ্কার, কুরুপপাতার ঝিরি হতে ওলারঝিরি নতুন পাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কার, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দরিদ্র কৃষকের মাঝে কৃষি উপকরণ বিতরণ এবং ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দরিদ্রদের মাঝে ছাগল বিতরণ। প্রতিটি প্রকল্পে ১০ মেট্রিক টন করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়।
সরজমিনে ‘কাঁঠালছড়া রোড হতে মাঙ্গঝিরি ফরিদ মিস্ত্রির বাড়ি অভিমুখী রাস্তা সংষ্কার’ প্রকল্পে গেলে দেখা যায় কাঁদামাটি ও খানাখন্দে রাস্তাটি এখন প্রায় চলাচল অনুপযোগী। স্থানীয় লোকজন জানান, এই রাস্তায় ইজিপিপি বা ৪০ দিনের কর্মসূচী ছাড়া অন্য কোন প্রকল্প হতে কাজ হয়নি। এই বিষয়ে স্থানীয় ইউপি মেম্বার জিয়াবুল ইসলামের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, রাস্তাটিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পর্যায়ে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী (ইজিপিপি) কর্মসূচীর আওতায় কাজ করেছি। এছাড়া অন্য কোন প্রকল্পের কাজ হয়নি। বিশেষ প্রকল্পের বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। একইভাবে লাইল্যারমার পাড়া রবিউলের দোকান হতে ডেসটিনি বাগান রাস্তা সংষ্কার, কুরুপপাতার ঝিরি হতে ওলারঝিরি নতুন পাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কার প্রকল্প স্থানে গেলে স্থানীয়রা কেউ এই প্রকল্পের বিষয়ে জানেন না বলে জানায়।
অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বরাদ্দ (জিও নং-২৯.০০.০০০০.২২৩.০২.০০৫.২০২১-২২) হতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ১০টি প্রকল্পের অনুকূলে ১০০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। প্রকল্প গুলো হল- সাপেরগারা হইতে ত্রিশডেবা সংযোগ সড়ক সংষ্কার, আড়াইমাইল নুরুল হকের বাড়ী হইতে ফোরকানের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কার, পাগলির আগা মসজিদ হইতে মোস্তাক পাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কার, ডানহাতি ছড়া জাফরের বাড়ী হইতে মোফাইদার বাড়ীর অভিমুখী রাস্তা সংষ্কার, ক্যচিং পাড়া হইতে মেম্বার পাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কার, গিলাতলী সোনামিয়ার বাড়ী হইতে নাপিতারঝিরি অভিমুখী রাস্তা সংষ্কার, ঠান্ডাঝিরি করিমের বাড়ী হতে ইলিয়াছের বাড়ী অভিমুখী রাস্তা সংষ্কার, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দরিদ্র মহিলাদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দরিদ্র কৃষকের মাঝে কৃষি উপকরণ বিতরণ এবং ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দরিদ্রদের মাঝে ছাগল বিতরণ।
সরজমিনে দেখা গেছে, ৫নং ওয়ার্ডের ‘আড়াইমাইল নুরুল হকের বাড়ী হইতে ফোরকানের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কার’ প্রকল্পের কোন কাজ হয়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও লোকজন বিশেষ প্রকল্পের সম্পর্কে জানেনা। ওয়ার্ড মেম্বার জানায়, ‘সাবেক চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদারের সময়ে প্রায় ৪ বছর আগে ফোরকানের বাড়ীর পাশে রাস্তার গাইড ওয়াল করা হয়েছিল। তারপর থেকে এই রাস্তায় আর কোন কাজ হয়নি। বিশেষ প্রকল্পের বিষয়ে আমরা জানিনা।’ একইভাবে অধিকাংশ প্রকল্পে কোনো কাজ করা হয়নি। তবে কাগজ-কলমে শতভাগ কাজ দেখিয়ে ‘ভুয়া’ মাষ্টাররোলের মাধ্যমে এসব প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ করা অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। এমনকি দুই অর্থবছরের ১৫০ টন বিশেষ প্রকল্পের বিষয়ে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনও জানেনা।
২০২১-২২ অর্থবছরের ১০টি প্রকল্পের মধ্যে তিনটি প্রকল্প (সাপেরগারা হইতে ত্রিশডেবা সংযোগ সড়ক সংষ্কার, পাগলির আগা মসজিদ হইতে মোস্তাক পাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কার ও ক্যচিং পাড়া হইতে মেম্বার পাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কার) চেয়ারম্যান ছিলেন, ১নং ওয়ার্ড মেম্বার মংমে মার্মা। তিনি বলেন, ‘আমি তখন নতুন মেম্বার হয়েছি। কিছুই বুঝিনা। চেয়ারম্যান বলেছে তাই আমি প্রকল্প চেয়ারম্যান হয়েছি। আমি ও আরেক মেম্বার সহ বান্দরবান জেলা পরিষদে গিয়ে মাষ্টাররোল/সমন্বয় ভাউচারে স্বাক্ষর করেছি। প্রকল্পের কাজ হয়েছে কিনা চেয়ারম্যান বলতে পারবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা বান্দরবান গিয়েছি নিজের পকেটের টাকা দিয়ে, গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত দেয়নি আমাদের।’
এবিষয়ে কথা হয় ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল হোসাইন চৌধুরীর সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা তো সাংবাদিকদের সাথে সমন্বয় করি। নিউজ না করলে হয়না। আলাচারিতার একপর্যায়ে তার কাছে সেলাই মেশিন, ছাগল ও কৃষি উপকরণ বিতরণের সুবিধাভোগীর তালিকা চাইলে তিনি ‘আপনাকে তালিকা দিতে হবে ?’ বলে ফোন কেটে দেন।’
লামা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম হেলালী বলেন, ২০২১-২২ অর্থ বছরের ৮০ টন চাল, ২০ টন গম আজিজনগর খাদ্য গুদাম হতে উত্তোলন করা হয়েছে। তবে গম না থাকায় ২০ টন গমের পরিবর্তে ১৪ টন ২০০ কেজি চাল দেয়া হয়েছিল। জেলা পরিষদের বরাদ্দকৃত চিঠির স্মারক নম্বর না থাকায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরের ডিও কোথায় থেকে উত্তোলন করা হয়েছে তা বলতে পারছিনা। দুই অর্থবছরের ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে একাধিকবার বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম কাউছার হোসেন কে তার মুঠোফোন ও অফিসের টিএনটি লাইনে ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
পার্বত্যকন্ঠ নিউজ/এমএস