• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৫ অপরাহ্ন

প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি- কিছু কথা

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, নিজস্ব সংবাদদাতা, লামা / ১৯৪ জন পড়েছেন
প্রকাশিত : রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সকল দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে।

২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ৫বছর থেকে বাড়িয়ে ৮ বছর করা হবে। অর্থাৎ ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত হবে প্রাথমিক স্তর। এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো, অবকাঠামোগত আবশ্যকতা মেটানো এবং প্রয়োজনীয় উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা।

দ্বিতীয়টি হলো, প্রাথমিক শিক্ষায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নতুন পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক-নির্দেশিকা প্রণয়ন করা। শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সালের মধ্যে ছেলেমেয়ে, আর্থসামাজিক অবস্থা ও জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব শিশুর জন্য পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছিল। যা প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ধারাবাহিক ও সমন্বিত শিক্ষাপ্রবাহ নিশ্চিত করতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এটি এত দিনেও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, পুরো বিষয়টি হতাশাজনক।

১১ বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর ৮ম শ্রেণিতে উন্নীত করার কাজ চলছে তবে কাজের কাজ হয়নি কিছুই। উল্টো নতুন শিক্ষাক্রমেও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই প্রাথমিকের স্তর থাকছে । আবার শিক্ষানীতি-২০১০ও বহাল রাখা হয়েছে যদিও এ দুটি সিদ্ধান্ত পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জাতীয় শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতায় পড়েছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাইলটিংভিত্তিতে বেশকিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু হলেও অর্থ সঙ্কট, অবকাঠামো ও শিক্ষক সঙ্কট আর শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখাই নীতি বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় হয়ে সামনে এসেছে। এ অবস্থায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পিছিয়ে ২০২১ সালকে ‘টার্গেট বছর’ নির্ধারণ করা হয়েছিল।

প্রত্যন্ত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি চালু হওয়ায় এলাকাভিত্তিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা সুফল বয়ে এনেছে। দরিদ্র এলাকার শিক্ষার্থীরা অন্তত ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। শিক্ষার নূন্যতম ৮ম শ্রেণি পযর্ন্ত পড়তে পারছে। এসমস্ত এলাকায় ৮ম শ্রেণি চালু না হলে হয়তো ৫ম শ্রেণিতেই লেখাপড়া শেষ হয়ে যেতো। গ্রামে বাল্য বিবাহ রোধে এটি অনেকাংশে সফল হয়েছে।

নীতি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে সারাদেশের হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভয়াবহ অবকাঠামো সঙ্কট। খোদ রাজধানীতেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা বেহাল। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই শিশুদের উপযোগী শ্রেণীকক্ষ। যাদের আছে তাও আকারে ছোট।

শিক্ষানীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালুর সরকারি উদ্যোগের বিষয়ে নানা সঙ্কটের কারণে বর্তমানের চালু রাখাই দায়। জটিলতা উত্তরণের চিন্তা ছাড়াই এতদিন ২০১৮ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, যাকে ভুল চিন্তা বলেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু কী কী সমস্যা আসলে সামনে চলে এসেছে? কেন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাচ্ছে? জানা গেছে, নীতি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে সারাদেশের হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভয়াবহ অবকাঠামো সঙ্কট। সঙ্গে আছে শিক্ষক সঙ্কট ও শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা চ্যালেঞ্জ। তবে এরই মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করার কাজ শুরু করেছে।

২০১৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৭৯৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির অনুমোদন দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। কোন কোন বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষকও দেয়া হয়নি। ফলে অনেক বিদ্যালয়ে এসব শ্রেণি চালু রাখাই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। সাত বছর আগে
শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। শিক্ষানীতির বিভিন্ন অংশ বাস্তবায়ন শুরু হলেও এর উল্লেখযোগ্য অংশ প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নির্ধারণ নিয়েই বেঁধেছে জটিলতা।

এককথায় বলতে গেলে ‘সর্বাঙ্গে ব্যাথা, ওষুধ দেব কোথা’ এমনই অবস্থা সারদেশে ৮ম শ্রেণি চালুকৃত বিদ্যালয়ে। সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত দেশের এ ধরণের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। এসকল বিদ্যালয়ের অভিভাবক প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ হলেও ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি অর্থাৎ জুনিয়র হাই স্কুল এর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল, অবকাঠামো ও অর্থের সংস্থান কোনটাই নেই।

বিকল্প পদ্ধতির বর্তমান পাঠদানের জন্য প্রাথমিকের বাড়ির কাজের পাশাপাশি ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত এ্যাসাইনমেন্ট বিতরণ করতে গিয়ে ত্রাহি মধুসুদন অবস্থা এসব বিদ্যালয়ের। দেখার কেউ নেই, নেই কোন পরিত্রানদাতা। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) থেকে কিছু বিদ্যালয়কে দেয়া হয়েছে ইআইআইএন নম্বরও। শিক্ষা বোর্ডের কাছে বরাবরই এসব বিদ্যালয় থাকে উপেক্ষিত, দায়িত্ব নেয়না প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। না ঘরকা, না ঘটকা অবস্থা এসব বিদ্যালয়ের। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ১৪টি করে ৩টি শ্রেণিতে বিষয়ের সংখ্যা ৪২টি। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৪২টি বিষয়ের শ্রেণি কার্যক্রম চালানোর চ্যালেঞ্জ দূর করার বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। শুরু থেকে অদ্যবধি পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মিত হয়নি। নতুন শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হয়নি। সরকারি প্রাথমিকের আছে অনেক সংগঠন কিন্তু ৮ম শ্রেণি চালুকৃত বিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো জোরালোভাবে উপস্থাপনে কেউই তেমনভাবে এগিয়ে আসেননি। সংখ্যায় কম হবার কারণে তাদের নিজেদের মধ্যেও তেমন কোন ঐক্য গড়ে ওঠেনি।
কর্তৃপক্ষও স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেনি সমস্যা সমাধানে।

সকল সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধানে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও ডিপিই মহাপরিচালকের হস্তক্ষেপ কামনা করি।

পর্যবেক্ষণ সমুহ হলো-
১. প্রয়োজনীয় শিক্ষক পদ সৃষ্টি করে দ্রুত পূরণের ব্যবস্থা করা।
২. প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন ভবন বা শ্রেণিকক্ষ তৈরি ও আসবাবপত্র সরবরাহ করা।
৩. মাধ্যমিক পর্যায়ের ICT সহ বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৪. লাইব্রেরি ও বিজ্ঞানাগার স্থাপন করা।
৫. ICT Lab স্থাপন।
৬. প্রয়োজনীয় কন্টিজেন্সির বরাদ্দ দেয়া।
৭. বই পরিবহণের অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া।
৮. প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ব্যতিত অন্যান্য অফিস ও বোর্ডে যাতায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রমণ ভাতার বরাদ্দ প্রদান করা।
৯. ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ প্রদান করা।
১০. জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষক, নিরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক ৮ম শ্রেণি চালুকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।
১১. বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের/ পালনের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া।
১২. অফিস সহকারী ও আয়া পদ সৃষ্টি করে পূরণের ব্যবস্থা করা।
১৩. উপজেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটিতে প্রধান শিক্ষকের অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা।
১৪. এ সকল বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যায় বেতন স্কেল প্রদান অথবা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৫. শিক্ষার্থী ভর্তি, সেশণ ফি, অন্যান্য ফি সমূহ সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন করে সুনির্দিষ্ট নির্দেশণা প্রদান করা।

এসব ন্যায় ও যুক্তিসংগত দাবীগুলো পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ৮ম শ্রেণি চালুকৃত বিদ্যালয়গুলোর চলমান সমস্যা কিছুটা দূর হবে বলে আশা করা যায়।

(আশীষ কুমার দত্ত মিন্টু)
প্রধান শিক্ষক
মেরাখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (প্রাক-৮ম শ্রেণি)
লামা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ