বন্য হাতির আক্রমণ থেকে ফসল ও বাগান রক্ষা করতে লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ পেতেছেন স্থানীয় শতাধিক কৃষক ও বাগান মালিকরা। হাতির মারার এইসব বৈদ্যুতিক ফাঁদে প্রতিনিয়ত মানুষ, হাতি সহ নানান জীবজন্তু মারা যাচ্ছে। বিষয়টি জেনেও কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন এমন অভিযোগ করেছেন স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন।
মহাবিপন্ন হাতি সংরক্ষণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ বন বিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘স্ট্রেনদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন’ প্রকল্পের আওতায় স্ট্যাটাস সার্ভে অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব এলিফ্যান্ট অ্যাকশন প্ল্যান ফর বাংলাদেশ উপ-প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৬ সালে মানুষ-হাতি সংঘাত নিরসনে বিস্তারিত ধারণা দেওয়ার জন্য একটি মাঠপর্যায়ের ব্যবস্থাপনা সহায়িকা প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে হাতির বাসস্থান, করিডর ও বিচরণভূমি ধ্বংস করছে। ফলে তারা লোকালয়ে চলে আসছে, এতে সংঘাত বেশি হচ্ছে। মানুষের ক্রমাগত বনে প্রবেশের ফলে হাতি তার সহজাত ভীতি বোধটুকু হারিয়ে ফেলে।
বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬ বছরে ৫৪টি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই মারা গেছে মানুষের হাতে। আর এ সময়ে হাতির আক্রমণে ১৩৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময়ে হাতি হত্যার ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ১৪টি। তবে একটি মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি, কেউ সাজা পেয়েছে এমন নজিরও নেই।
গত সোমবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের রাঙ্গাঝিরি, খালখুইল্যা পাড়া, বড় ছনখোলা, কুমারী, চাককাটা, বিচুইন্না, ফুটের ঝিরি, বাম হাতির ছড়া, ডান হাতিরছড়া, জলপাইতলী, হাইদারনাশী, পাঁচ মাইল, কবিরার দোকান, ঘিলাতলী, বগাইছড়ি, অংসারঝিরি, কুরুপপাতা ঝিরি এলাকায় ফসলের জমি ও বাগানের ধারে বৈদ্যুতিক ফাঁদের জিআই তারের সঙ্গে ঝুলছে সাদা পলিথিনের টুকরো। মাইলে পর মাইল ধরে এইসব দেখা যায় বৈদ্যুতিক ফাঁদের।
বৈদ্যুতিক ফাঁদের উৎসের অবস্থান জানতে ইউনিয়নের রাঙ্গাঝিরি এলাকার মেঠোপথ ধরে যেতে দেখা যায় গরুর দল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন রাখাল ও কৃষকরা। খোলা অবস্থায় বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদের পাশেই মানুষের চলাচল। সংযোগ থাকলে যে কোনো সময়ই হতে পারে প্রাণহানি। বৈদ্যুতিক তার অনুসরণ করে সামনে যেতেই কয়েকটি টিনশেড ঘর। একটি ঘরের উঠানেই বৈদ্যুতিক তারের সংযোগসহ একটি বিদ্যুতের লাইন। সূর্য ডুবলেই এটি সক্রিয় হয়ে ওঠে।
রাঙ্গাঝিরি তথা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুর রহিম বলেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ইং রবিবার সন্ধ্যায় ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ৫নং ওয়ার্ডের ফুঁটেরঝিরি এলাকায় হাতি তাড়ানোর বৈদ্যুতিক ফাঁদে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে হয়ে মোঃ ইলিয়াস (৪২) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। সে ফুটেরঝিরির মোঃ আমির হোসেন এর পুত্র। স্থানীয় একজন গণমাধ্যম কর্মী মোঃ ফরিদুল আলম বাবলু বলেন, গত দুই বছরে বৈদ্যুতিক ফাঁদে ৪/৫ জন লোক মারা গেছে।
লামা বন বিভাগের এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম এর সদস্য ও রাঙ্গাঝিরি এলাকার বাসিন্দা মোঃ ফরিদ বলেন, বন্য হাতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে প্রতিবছর বন বিভাগ লাখ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়। আমরা যারা ইআরটি সদস্যরা আছি মানুষ খবর দিলে আমরা হাতি তাড়িয়ে দেই এবং সরকারি ভাবে ক্ষতিপূরণ পেতে সহায়তা করি। বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে মানুষ হাতি মারলে সরকার এত টাকা দিয়ে লাভ কি ?
জানা যায়, মূলত হাতির আক্রমণ থেকে ফসল ও বাগান রক্ষায় বাঁশ ও কাঠের খুঁটি পুঁতে জিআই তার দিয়ে বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ পাতা হয়। এটি দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে কৃষকরা। লামা বিদ্যুৎ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলী মোঃ সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এরকম কিছু পেলে আমরা দ্রুত আইনী ব্যবস্থা নেব।
ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল হোসাইন চৌধুরী বলেন, কৃষকরা অনেক কষ্ট করে ফসল ফলায়। যতটুকু জানি কৃষকরা হাতির আক্রমণ থেকে ফসল, বাগান রক্ষায় রাতে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে ঢোল বাজিয়ে শব্দ করে ফসলের পাহারা দেয়। হাতি রক্ষায় আইন-কানুন সম্পর্কে অনেকেই জানেনা। বৈদ্যুতিক ফাঁদের ব্যবহার কমাতে তিনি বন বিভাগের সহায়তা চেয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লামা বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ আরিফুল হক বেলাল বলেন, বনে খাদ্যের অভাবে হাতি লোকালয়ে চলে আসছে। এ কারণে মানুষ ও হাতির মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ বেড়েছে। এটা এড়াতে প্রচলিত কৌশল বা পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা অনেকবার অভিযান করে বৈদ্যুতিক ফাঁদ উচ্ছেদ করেছি।
এম/এস