আবদুল মান্নান,মানিকছড়ি:
পার্বত্য চট্টগ্রামে মংসার্কেল বা মংরাজার শাসনামলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি মংরাজ বাড়ি। পার্বত্য চট্টগ্রামের মংসার্কেলের ইতিহাস,ঐতিহ্য অনেক পুরনো।
১৭৯৬-১৮২৬ সময়ের মংরাজা কংজয় বাহাদুরের রাজত্বকাল থেকে মংরাজ বাড়ীর ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারাবাহিক ইতিহাস খুঁজে দেখা গেছে, প্রথম রাজা কংজয়ের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কিওজা সেইন ১৮৬১ সালে মানিকছড়ি রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর রাজকুমারী নানুমা দেবী (১৯২৯-১৯৫৪) তাঁর নামানুসারে মানিকছড়ি রাজবাড়িতে নানুমা দেবী হল নির্মাণ করে তাঁর প্রয়াত পিতা নিপ্রুসাইন বাহাদুরের নামে উৎসর্গ করেন। এভাবেই মংসার্কেলের প্রাচীন নিদর্শনগুলো কালের স্বাক্ষী হয়ে এখনো শতশত বছরের ঐতিহ্যগুলো নতুন প্রজন্মদের জানান দিচ্ছে মংসার্কেল বা মংরাজার আদিবাসের স্মৃতি। রাণী নানুমা দেবীর একমাত্র পুত্র সন্তান ও ৭ম রাজা মংপ্রু সেইন( ১৯৫৪-১৯৮৪) তাঁর রাজত্বকালে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে নিজের ধন-সম্পদ বিলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধাহত মানুষের জন্য তাঁর মা’য়ের নানুমা দেবী হলে প্রতিষ্ঠা করেন চিকিৎসালয়। রাজা নিজের ৩৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বৈদেশিক মুদ্রা মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে নিজে অস্ত্র হাতে নিয়ে একজন সম্মুখ সারির যুদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হন। কিন্তু এই শত শত বছরের ঐতিহ্যে ঘেরা মংরাজ বাড়ির একতল বিশিষ্ট দালান ঘর ও নানুমা দেবী হল, জাদী, বৌদ্ধ বিহারসহ রাজপ্রাসাদে থাকা রাজ শাসনামলের বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংস্কারের অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফলে সম্প্রতি প্রয়াত রাজা মংপ্রু সেইনের দৈহিত্ররা(নাতি) নিজ উদ্যোগে মহামুনি টিলার স্মৃতিময় জাদী ও বিহার সংস্কারের শুরু করেন। অন্যদিকে পার্বত্য জেলা পরিষদ খাগড়াছড়ির অর্থায়নে সংস্কার শুরু হয় রাজ বাড়ির বিভিন্ন স্থাপনা এবং পুনঃরূপ দেওয়া হয়েছে অযত্নে পড়ে থাকা নানুমা দেবী হলের কারুকাজগুলো।
এতে পরিপূর্ণতা ও শতশত বছরের ঐতিহ্যগুলো নতুনরুপ পেতে শুরু করে। নতুন প্রজন্মরা জানতে ও দেখতে চায় রাজশাসনানলের স্মৃতিময় পুরাকৃতি ও নিদর্শনগুলো। ফলে সংস্কার কাজ শেষে এসব ঐতিহ্য ও পুরাকৃতি নিদর্শনগুলো অনুমতি সাপেক্ষে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে বলে আজকের পত্রিকাকে জানান প্রয়াত রাজা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মংপ্রু সাইন বাহাদুর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কুমার সুইচিংপ্রু। তিনি আরও জানান, ১৩০২ মঘাব্দে চতুর্থ মংরাজা কুমার নিপ্রুসাইন বাহাদুরকে উৎসর্গ করে তাঁর মেয়ে নানুমা দেবী রাজবাড়িতে গড়ে তোলেন নানুমা দেবী হল। আর এই হলেই রাজ্য অভিষেক, খাজনা আদায় ও হেডম্যান কার্বারীদের নিয়ে আলোচনা সভাসহ নানা আচার অনুষ্ঠান হতো।
রাজবাড়ির ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, তৎকালীন মং রাজা কুমার নিপ্রুচাঁইনের কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তার একমাত্র কন্যা নানুমা দেবীকে সহকারী মং চিফ হিসেবে মনোনীত করে ব্রিটিশ প্রশাসন। সেই সময় তার নামেই নির্মাণ করা হয়েছিল দৃষ্টিনন্দন এই নানুমা দেবী হল। দীর্ঘদিন অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকায় ভবনটি ছাদ ও অভ্যন্তরে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে একতলা বিশিষ্ট মূল রাজবাড়ির ঘর ও নানুমা দেবী হলের সংস্কার শুরু হয়। ফলে স্থাপনাগুলো ফিরে পেয়েছে পুরোনো রুপ। একইসাথে হলের ভেতরে থাকা ২০টি এঞ্জেল, ১৭টি বৌদ্ধ মুর্তি, সিলিং বোর্ড, ৭টি চক্র, বৌদ্ধধর্মীয় ও দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক দৃশ্য অংকিত ১৬টি পেইন্টিংসহ পুরোনো সেই নানুমা দেবীর আমলে নির্মিত কারুকাজের আদলে রং তুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন রাজ পরিবারের এ প্রজন্মের সদস্য বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মাক্রাইওয়াং (ডিমপল রায়)। এতে সহযোগিতা করছেন তার বড়বোন নেই ঈ চেইং। পূর্বপুরুষদের নিদর্শনগুলো নিজেদের হাতে নতুনরূপ দিতে পেরে উচ্ছ্বসিত তারা। এর আগে গত ১৪ এপ্রিল নানুমা দেবী হলের সংস্কার কাজের উদ্বোধন করেন খাগড়াছড়ি সাংসদ ও ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরনার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি। পুনঃসংস্কার কাজের তদারকী করেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ জব্বার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান মানিকছড়ি মং রাজবাড়ি। রাজ শাসনামলের ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের লক্ষ্যেই সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা পরিষদ। সে লক্ষেই কাজ করা হয়েছে’। নানুমা দেবীর পৌত্র (পুতি) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মংরাজা মংপ্রু সাইন বাহাদুর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কুমার সুইচিং প্রু বলেন, প্রায় শত শত বছরের পুরোনো রাজ প্রাসাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও নানুমা দেবী হল সংস্কারের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া রুপ ফিরে পেয়েছে মংরাজার আদিবাস ৷ এসব স্থাপনা রাজ পরিবারের হলেও এর ইতিহাস ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে পৌছে দিতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে এখন থেকে অনুমতি সাপেক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে রাজবাড়ি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দর্শনার্থীরা অনুমতি সাপেক্ষে দেখতে পারবে স্থাপনাগুলো। ফলে তারা শত শত বছরের পুরোনো মং রাজবাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানতে পারবে।
উল্লেখ্য, মং রাজবংশের সপ্তম রাজা মং প্রু সাইন ছিলেন একজন বীর মুক্তিযুদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন তিনি।
মুক্তিবাহিনীদেরকে যুদ্ধ করার জন্য ৩৩ ধরনের অস্ত্র, গাড়ি ও খাবারের রসদ যোগান দেন। এছাড়াও যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম থেকে মানিকছড়ি-রামগড় হয়ে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাংলাদেশী শরনার্থীদের রাজবাড়িতে আশ্রয় এবং খাবার, চিকিৎসা ও থাকার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজবাড়িতে আক্রমণ করলে রাজা তার পুরো পরিবার নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। আর সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ট্যাংক বহরের সাথে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে উক্ত রাজবাড়িতে ফিরে আসেন এবং ১৯৮৪ সালে রাজা মংপ্রু সাইন মুত্যুবরণ করেন।