• মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:২৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম
রামগড় ৪৩ বিজিবির অভিযানে ৩০ কেজি গাঁজা জব্দ দেবিদ্বারে জুলাই হত্যাচেষ্টা মামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেফতার ৬১ হাজার উদ্বাস্তু পার্বত্য বাঙালি পরিবারের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে কে? লংগদুতে রাজনগর বিজিবি জোনের উদ্যোগে ভলিবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলা অনুষ্ঠিত দীঘিনালায় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশের দিনব্যাপী ডমিনেন্স পেট্রোলিং কাপ্তাই বন্যহাতির আক্রমণে নিহত ১, আহত ১ অটোরিকশা ভাংচুর দীঘিনালায় দুই বসতবাড়িতে ভয়াবহ চুরি লামায় ইটভাটা অভিযান রুখতে কাপনের কাপড় পরে শ্রমিকের রাস্তা অবরোধ লামায় বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সাচিং প্রু জেরীর নির্বাচনী পথসভা পাহাড়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণী রক্ষার স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়ে উদ্বুদ্ধকরণ সভা মানিকছড়িতে শিক্ষার মানোন্নয়নে মুক্ত আলোচনা অনুষ্টিত দীঘিনালায় মেধাবৃত্তি প্রদান ও গুণীজন সংবর্ধনা: শিক্ষাঙ্গনে আনন্দঘন আয়োজন

লক্ষ্মীছড়িতে অস্ত্রের ঝনঝনানি; সেনা উপস্থিতির অপরিহার্যতা: রিকো চাকমা

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ / ২৩২ জন পড়েছেন
প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার ‘বর্মাছড়ি’—পাহাড়ের কোলঘেঁষা এক নির্জন কোণ, যেখানে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক অবিরাম সংগ্রাম। এখানে বাতাসে শুধু পাহাড়ি ঝরনার কলধ্বনি নয়, মিশে থাকে অস্ত্রের ঝনঝনানি, নিঃশব্দ ভয়, আর অজানা আতঙ্কের গুমোট ছায়া। আমি রিকো চাকমা, এই বর্মাছড়ির মাটির সন্তান। আমার চোখে দেখা বাস্তবতা, আমার হৃদয়ে ধরা বেদনা, আর আমার জীবনের অভিজ্ঞতায় গড়া এই কথন—একটি নির্মম সত্যের আখ্যান, যা কেবল সংখ্যার পরিসংখ্যান নয়, বরং প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের গল্প। আমি আজ লিখছি, কারণ নীরবতা আর সহ্য হয় না; আমি লিখছি, যাতে শান্তি, নিরাপত্তা, আর মানবিক মর্যাদার পথে আমরা একসঙ্গে হাঁটতে পারি।

 

বর্মাছড়ি, একটি নাম, যা এখন সংবাদের শিরোনামে, সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সরকারি তথ্যে এখানকার জনসংখ্যা প্রায় সাত হাজার, যাদের অধিকাংশই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সদস্য। কিন্তু এই সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে অগণিত জীবনের অব্যক্ত যন্ত্রণা। আমাদের গ্রাম, আমাদের পথঘাট, আমাদের ঝিরিঝরনা—সবই যেন এক অদৃশ্য আতঙ্কের কবলে। ইউপিডিএফ-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর আতঙ্ক এখানকার প্রতিটি দিনকে গ্রাস করেছে। আমরা বাজারে যেতে ভয় পাই, আমাদের সন্তানেরা স্কুলের পথে নিরাপদ নয়, আমাদের জুমচাষের ক্ষেত্রে অস্ত্রের ছায়া পড়ে। আমি নিজে দেখেছি—চাঁদাবাজির নির্মম দাবি, অপহরণের হিমশীতল হুমকি, এমনকি খুনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। এই ভয় আমাদের জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে, যেন আমরা শান্তির স্বাদ ভুলে গেছি।

 

সাম্প্রতিক সময়ে বর্মাছড়িতে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে উত্তেজনা বেড়েছে। ইউপিডিএফ এই ক্যাম্পের বিরোধিতা করছে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উস্কানি দিয়ে তাদের নিজেদের সন্ত্রাসী তৎপরতা টিকিয়ে রাখতে চাইছে। কিন্তু আমি প্রশ্ন করি—কেন সেনা ক্যাম্পের প্রয়োজন? উত্তরটা সহজ, কিন্তু তা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত। আমরা চাই নিরাপদে বাঁচার অধিকার। আমরা চাই আমাদের মায়েরা বাজারে যাক, আমাদের শিশুরা স্কুলে যাক, আমাদের কৃষকরা ভয় ছাড়া জুমচাষে ফিরে যাক। এই মৌলিক অধিকারগুলো এখানে স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউপিডিএফ-এর চাপে বহু পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছে, বহু যুবক জোর করে তাদের সশস্ত্র দলে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। আর যারা রয়ে গেছে, তারা বেঁচে আছে এক শ্বাসরুদ্ধকর আতঙ্কের মধ্যে।

 

কেউ কেউ বলেন, সেনা ক্যাম্প এলে ধর্মীয় আচার বা পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘিত হবে। কিন্তু আমি বলি—খিরাম আর শুকনাছড়ির সেনা ক্যাম্পগুলো কখনোই স্থানীয়দের ক্ষতি করেনি। বরং, সেখানকার মানুষ সেনার উপস্থিতিতে নিরাপত্তা অনুভব করে। পাহাড়ি পথের সংকীর্ণতা, গ্রামগুলোর বিচ্ছিন্নতা—এসবের মাঝে সত্যিকারের নিরাপত্তা পৌঁছে দিতে হলে স্থানীয় সেনা উপস্থিতি অপরিহার্য। এটা কেবল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্ন নয়, এটা আমাদের—সাধারণ মানুষের—বেঁচে থাকার অধিকারের প্রশ্ন।

 

আমি শুনেছি সেই গোপন কণ্ঠস্বর, যারা নাম প্রকাশের ভয়ে চুপ থাকে, কিন্তু হৃদয়ে বলে, “সেনা থাকলে আমাদের ভয় কমবে। চাঁদাবাজি বন্ধ হবে, অপহরণের আতঙ্ক কমবে, আমাদের সন্তানেরা নিরাপদে বড় হবে।” এই কণ্ঠস্বর আমার নিজের নয়, এটি বর্মাছড়ির প্রতিটি ঘরের, প্রতিটি মানুষের। আমরা শান্তি চাই, আমরা মুক্তি চাই—অস্ত্রের ছায়া থেকে, ভয়ের শৃঙ্খল থেকে।

 

ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়—পার্বত্য এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান নতুন নয়। তারা বাইরের সাহায্যে অস্ত্র সংগ্রহ করে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখে। কিন্তু এই অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আমাদের জীবন থমকে যায়। আমাদের চাষ, আমাদের বাণিজ্য, আমাদের স্বপ্ন—সবই ধ্বংসের মুখে। সেনা ক্যাম্প এখানে কেবল শক্তির প্রদর্শন নয়; এটি আমাদের জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার একটি পথ।

 

কেউ হয়তো বলবেন, সেনা এলে স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। কিন্তু আমি বলি—আমাদের স্বাধীনতা এখনই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ইউপিডিএফ-এর ভয়ে আমরা স্বাধীন নই। আমরা চাই এমন নিরাপত্তা, যেখানে আমাদের নারীরা নির্ভয়ে পথ চলতে পারে, যুবকরা ভয় ছাড়া স্বপ্ন দেখতে পারে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, যারা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে, তারা নিশ্চয়ই এখানেও মানবাধিকার ও নাগরিক নিরাপত্তার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ।

 

ইউপিডিএফ প্রায়ই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। তারা ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানায়। কিন্তু আমি বলি—ধর্ম শান্তির পথ, অশান্তির ছদ্মবেশ নয়। আর্য কল্যাণ বনবিহারের নামে যে আপত্তি তোলা হচ্ছে, তা কেবল একটি অজুহাত। বর্মাছড়িতে জায়গার অভাব নেই, আর সত্যিকারের বিহারের সঙ্গে এই জায়গার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি শুধু সন্ত্রাসী তৎপরতা টিকিয়ে রাখার একটি চাল।

 

স্বায়ত্তশাসনের বুলি তুলে বহু প্রতীক্ষিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করেছে ইউপিডিএফ। কিন্তু প্রশ্ন হলো— এই দীর্ঘ সাতাশ বছরে তারা পাহাড়ি জনগণকে কী দিয়েছে? যদি আজও আমরা এই প্রশ্নের গভীরতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হই, তবে তা শুধু একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং জাতি হিসেবে আমাদের এক ভয়াবহ ক্ষতি।

 

বাস্তবতা হলো— চুক্তির পক্ষে কিংবা বিপক্ষে, উভয় দলই জাতির অধিকারের কথা বলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে লিপ্ত হয়েছে। চাঁদাবাজি, নিয়ন্ত্রণ, আর প্রভাবের লড়াইয়ে তারা পরস্পরকে মোকাবিলা করতে গিয়ে দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে সংঘর্ষ, সন্দেহ আর আতঙ্কের রাজত্ব।

একদিকে চুক্তির পক্ষে থাকা সংগঠনগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে প্রভাবের ক্ষেত্র রক্ষা করছে; অন্যদিকে চুক্তিবিরোধীরা সেই শান্তিকে রক্তে রঞ্জিত করছে। ফলাফল— সাধারণ পাহাড়ি মানুষের জীবন আজও বন্দি ভয়, টানাপোড়েন ও দারিদ্র্যের ছায়ায়।

এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। এখন সময় এসেছে, স্বার্থের মুখোশে আড়াল হওয়া রাজনীতিকে অতিক্রম করে পাহাড়ের মানুষকে ভয়ের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার; শান্তি ও নিরাপত্তাকে ফিরিয়ে আনার প্রকৃত রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার সময় এটি।

 

শেষ কথা, বর্মাছড়ির মানুষ নির্জনতায় বাঁচতে চায় না। আমরা চাই শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপদ রাস্তা, আর ভয়হীন জীবন। সেনা ক্যাম্প শুধু অস্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, এটি আমাদের অধিকার ফিরিয়ে আনার লড়াই। আমি, রিকো চাকমা, দেশবাসীর কাছে অনুরোধ করি—আমাদের কণ্ঠ শুনুন। আমরা শান্তি চাই, আমরা জীবন চাই। রাষ্ট্র, সমাজ, আর সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বর্মাছড়ি আবার শান্তির আলোয় উদ্ভাসিত হবে। এটাই আমাদের স্বপ্ন, এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা—একটি জীবন, যেখানে অস্ত্রের ছায়া ছাড়া আমরা নির্ভয়ে হাঁটতে পারি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ