অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা যখন পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন তখন পার্বত্যজেলা বান্দরবানে গ্রামীণ সড়ক সংস্কার, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের নামে সদর উপজেলার বান্দরবান-কেরানীহাট থেকে রেইচা-গোয়ালিয়াখোলা পর্যন্ত রাস্তার দু'পাশে থাকা হাজারের বেশি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, আমানউল্লাহ নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী এসব গাছ কাটছেন। ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে।
জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ অফিসের তথ্যমতে, বান্দরবান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর 'এলজিইডি' ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রাস্তাটি সম্প্রসারণ পূর্বক দৃঢ় ও উন্নয়নকরণ পরিকল্পনায় একটি প্রকল্প হাতে নেয়। রাস্তাটির দৈর্ঘ্য সাড়ে সাত কিলোমিটার৷ বর্তমানে তিনটি প্যাকেজে সড়কটি সংস্কারে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
রাস্তা সংস্কার কিংবা সম্প্রসারণের কাজ শুরু হওয়ার আগেই পাঁচ শতাধিক গাছ কেটে ফেলেছে চক্রটি। গাছগুলো গোড়ালি থেকে কাটা হয়েছে। কাটার পর স্কেভেটর দিয়ে গাছের গুড়ি উপড়িয়ে ফেলে সেখানে মাটি ভরাট করে দিয়েছে, যেন গাছ কাটার পর চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
রেইচা হতে গোয়ালিয়াখোলা পর্যন্ত সড়কের পাঁচ শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে।
এলাকাটি একাধারে পাহাড়-টিলা, সমতল কৃষিজমি এবং সাঙ্গু নদীর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা আছে। তাই এখানে সব ঋতুতেই ফসল ফলে। তাই সড়কের আশেপাশের এলাকাটি জেলার সর্বোচ্চ সমতল তথা কৃষিভূমির জন্য বিখ্যাত বলেই স্থায়ীদের মুখে এলাকাটি বান্দরবানে "হৃদপিণ্ড" বা বান্দরবানের সবজি উৎপাদনের রাজধানী নামেও পরিচিত। এই রাস্তার দু'পাশে বেষ্টিত আছে হাজারের অধিক বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ।
অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার দু'পাশে বিশাল সমভূমি। রাস্তার দু' পাশে গাছগুলো দাঁড়িয়ে বহু বছর ধরে যেমন ছায়া দিয়ে যাচ্ছে তেমনি সমতল মাঠজুড়ে বিভিন্নধরনের শাকসবজির ক্ষেত। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এর মধ্যে রাস্তার দু'পাশে থাকা গাছের মধ্যে থেকে ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে।
অনেক গাছে ডালপালা ছেটে রাখা হয়েছে। অনেক গাছের গুড়ি স্ক্যাভেটর দিয়ে উপড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।
গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিক মোহাম্মদ রফিক ও নজরুল বলেন, আমাদেরকে আমানউল্লাহ আমান নামে এক ব্যবসায়ী গাছগুলো কাটার জন্য বলেছেন। আমরা চার দিন ধরে কাটছি। ৫৫-৬০টার মতো গাছ কাটতে পেরেছি। রাস্তার দু'পাশের সবকটি গাছ কাটা হবে বলে জানান তারা।
গাছকাটা শ্রমিকরা আরও বলেন, আমরা দিনের বেলায় গাছের ডালপালাগুলো কেটে রাখি। রাতে এসে গাছের গোড়ালি থেকে কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যাই। আর একদল, পরের দিন স্ক্যাভেটর দিয়ে গোঁড়ালি গুলো উপড়িয়ে ফেলে মাটিদিয়ে ভরাট করে রেখে দেয়। যেন সহজে গাছকাটার চিহ্ন বুঝতে না পারে।
গাছ কাটার জন্য ছাটাই করা হয়েছে ডালপালা।
গোয়ালিয়া খোলা গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা মোহাম্মদ নুরুচ্ছফা (৭০) বলেন, আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এই গ্রামেই। আমার বয়স এখন ৭০ বছর। বহুবছর ধরে দেখে আসছি রাস্তার দু'পাশে হাজারো অধিক গাছ আছে। এই গাছগুলোর বয়স সর্বনিম্ন ২৫ বছর থেকে কমপক্ষে ৬০ বছর।
স্কুলের সামনে মেহগনি, শিশুগাছসহ এই রাস্তায় অনেক গাছ ছিলো জানিয়ে তিনি বলেন, এসব গাছের বয়স আমার বয়সের কাছাকাছি। কিছু গাছ আমার বয়সের চেয়েও বড়। এই রকম ২৫-৫০-৬০ বছর বয়সী হাজার হাজার গাছ ছিলো। এর আগেও অনেকবার কাটা হয়েছে। গাছ এখনো যা আছে সংখ্যায় হাজারের অধিক হবে। শুনেছি রাস্তা বড় করা হবে বলে এই গাছগুলো নাকি কেটে ফেলা হবে, শুনে খুব কষ্ট পেয়েছি।
মামলা চলমান অবস্থায় গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে আমানউল্লাহ আমান রাস্তার সম্প্রসারণের কাজে দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদার মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের নির্দেশের কথা জানান। তার নির্দেশে গাছগুলো কাটছেন স্বীকার করে জানান, ২০১৮ সালে নিলামে ডাক পাওয়ার পর প্রায় ২৬০-৭০টি গাছ কেটেছিলেন।
তারপর মামলা হলে আদালতের নির্দেশে গাছ কাটা বন্ধ করেছেন। আবার রাস্তার ঠিকাদার খোরশেদ আলমের নির্দেশেই গেলো ১০-১৫ দিনে ৫০-৬০ টার মতো গাছ কেটেছেন বলে জানান তিনি।
বান্দরবান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুর রহমান বলেন, রেইচা গোয়ালিয়াখোলা রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য রাস্তার দুই পাশের গাছ কর্তনে বাধা পেয়ে একজন আদালতে মামলা করেছেন। বাদী বনবিভাগকেও ৪ নাম্বার বিবাদী করেছেন। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক বনবিভাগ থেকে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন বনবিভাগ তা পালন করবে জানিয়ে তিনি বলেন, বান্দরবান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এব্যাপারে বিস্তারিত বলতে পারবে। প্রকৌশল অধিদপ্তরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী পারভেজ সারোয়ার হোসেন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলজিইডি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। যেহেতু রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্যই কাজ করে, সেহেতু রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জনগণ এবং পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ "এলজিইডি" করবে না। এলজিইডি কাউকে গাছকাটা কিংবা পরিবেশ ধ্বংসের জন্য সুপারিশ বা অনুমতি প্রদান করতে পারেন না বলে জানান তিনি।
সম্পাদকঃ এম. শাহীন আলম।। প্রকাশকঃ উম্মে হাবিবা
যোগাযোগ: ০১৬৪৭-৬২৭৫২৬/ ০১৮২৩-৯১৯০৯৫ whatsapp
parbattakantho@gmail.com
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
পার্বত্য কন্ঠ © ২০১৮-২০২৪ সংরক্ষিত