মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ব্যুরো প্রধান, বান্দরবান:
সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের তিন শতাধিক সেগুন গাছ বেঁচে তিন কোটি টাকা আত্মসাত করার ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিম ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে এসেছেন। বন বিভাগের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ বন সংরক্ষক মোহাম্মদ হোছাইন এর নেতৃত্বে তদন্ত টিম বৃহস্পতিবার (১৬ মে) বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে। তিনজন বিভাগীয় বন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত প্রায় ১৫ জনের টিম তৈন রেঞ্জের কাঁকড়ারঝিরি আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখেন।
জানা যায়, বান্দরবানের লামা বন বিভাগের অধীনে থাকা সরকারের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের তিন কোটি টাকার মূল্যবান সেগুন গাছ বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তৈন রেঞ্জ কর্মকর্তা জুলফিকার আলী নামে ওই বনের ই এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। কাঠ ব্যবসায়িরা কিনে নেয়া এসব গাছ ইতিমধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কয়েকটি স্থান থেকে কয়েক দফায় কেটে নিয়ে গেছেন।
এদিকে গাছ বিক্রির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দপ্তর হতে তিন সদস্যসের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দপ্তরের সিনিয়র বন কর্মকর্তা হাবিব উল্লাকে আহবায়ক এবং লামার সদর রেঞ্জ কর্মকর্তাকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। এছাড়া ডলুছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তাকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত কাজ শেষ করে প্রতিবেদন দায়েরের জন্য কমিটিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আরিফুল হক বেলাল। ডিএফও বলেন, সংরক্ষিত বন থেকে গাছ পাচারের ঘটনা জানতে পেরে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরই জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কাঁকড়ারঝিরি বনের আশপাশে বসবাস করা উপজাতি লোকজন জানান, কোনো বন কর্মকর্তা এই প্রথম সরাসরি ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে সরকারি সংরক্ষিত বনের কাটা নিষিদ্ধ গাছ বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাত করলেন। আর এই ঘটনার মধ্যদিয়ে ওই বনাঞ্চলে থাকা সরকারের হাজার কোটি টাকার সেগুন গাছের নিরাপত্তা নিয়ে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে!
স্থানীয়রা আরো জানান, সংঘবব্ধ চোর চক্র গহিন বনের মধ্য থেকে বিশাল বিশাল সেগুন গাছ কেটে নিয়ে গেছে। যেসব গাছের বয়স ৪০ হতে ৫০ বছর পর্যন্ত। আর এসব গাছ পরিবহনের জন্য সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের মধ্যেই স্কেভেটর দিয়ে বন ও পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করেছে সেই চোরেরা। সম্প্রতি বনের গাছ পাচারের খবর জানাজানি হওয়ার পর বিভাগীয় বন কর্মকর্তাসহ (ডিএফও) উর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা বনাঞ্চল পরির্দশনে গেলে এই রাস্তাটি সবার দৃষ্টিতে আসে।
এই ঘটনায় ক্লোজড জুলফিকার আলীর দাবি, এসব গাছ বিক্রি নয়, চুরি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, গত ছয় মাস আগে তৈন রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যোগদান করেছেন। সেই থেকে স্থানীয় বন বিট কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক ও বাগান মালি অলক বাবু এতদিন গাছ চুরি সম্পর্কে তাকে কিছুই জানান নি। তবে সম্প্রতি গাছ পাচারের খবর বিভিন্ন মাধ্যমে জানাজানি হওয়ার পর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। সেই কমিটি ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছ চুরির প্রমানও পেয়েছে। চুরি যাওয়া সামান্য কিছু কাটা গাছ জব্দ করা হয়েছে।
তৈন রিজার্ভ হতে কাটা এইসব গাছ লামা ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বনপুর ও কাঠালছড়া দিয়ে চকরিয়ার মালুমঘাটের দিকে নিয়ে গেছেন। ওইসব এলাকার লোকজন বলেন, বলেন, জুলফিকার আলী যোগদানের তিন মাস না যেতেই তৈন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের তিন শতাধিক কাটা নিষিদ্ধ সেগুনগাছ কাঠ ব্যবসায়িদের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন। কাঠ ব্যবসায়িরা গাছ পরিবহনের জন্য স্কেভেটর দিয়ে সংরক্ষিত বন ও পাহাড় কেটে ট্রাক চলাচল করার মতো রাস্তাও তৈরি করে নিয়েছে।
লামা বন বিভাগ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৪, ৮৫ ও ৮৬ সালের দিকে লামা ও আলীকদমের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা তৈন মৌজায় ৫৭ হাজার একশত ৮৪ একর জায়গায় সরকারি অর্থায়নে সেগুন বাগান সৃজন করা হয়। নিয়মানুসারে সে সময় থেকে লামা বন বিভাগের তৈন রেঞ্জ এই বন সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে আছে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজার করার পর এবার তৈন সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস যজ্ঞ চলছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপ বন সংরক্ষক মোহাম্মদ হোছাইন বলেন, গাছ কোথায় গেছে, কি হয়েছে তা তদন্তে বেড়িয়ে আসবে। এই জন্য তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়েছে।