মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ব্যুরো প্রধান, বান্দরবান,
‘কত কে এলো গেল, কত জন আসবে’ আমরা ঠিকই ভাটা চালাবো। যারা ইটভাটা বন্ধ করবে (পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান) তাদের সাথে আমাদের টেবিল সম্পর্ক। ঊনারা এখানে এসে দেশি মুরগি খেয়ে যায়। শুধু খায় না, নিয়েও যান। এবছর নতুন ইটভাটা করতে ১২ লাখ ও প্রতিটি অবৈধ ইটভাটার জন্য ৪ লাখ করে দেয়া হয়েছে। মাঝেমধ্যে টুকটাক যে অভিযান করে তা নাটক। লোক দেখানো মাত্র। গত ২১ বছরের ফাইতং এর একটি ইটভাটাও কি ভাংতে পেরেছে প্রশাসন ! এভাবে দীপ্তকন্ঠে দম্ভ দেখিয়ে সাংবাদিকদের কথা গুলো বলেন লামার ফাইতং ফাদুরছড়া এলাকার সেভেনবিএম ও ইউবিএম ইটভাটার মালিক কবির খাঁন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ফাইতং ইউনিয়নের ফাদুরছড়া গ্রামে এবছর নতুন করে নির্মিত সেভেনবিএম ইটভাটা তিন পাশে স্কেভেটর দিয়ে পাহাড় কাটছে। ইতিমধ্যে দুইটি বিশাল পাহাড় সাবাড় করেছে এই ব্রিকফিল্ডটি। নতুন করে আরো একটি পাহাড় শুরু করেছে। জ্বালানী হিসাবে মজুদ করা হয়েছে বনের হাজার হাজার ঘনফুট লাকড়ি। এই বিষয়ে কথা হয় এই ভাটার মালিক কবির খাঁনের সাথে। তিনি বলেন, ‘অনুমতি না থাকলেও সবাইকে ম্যানেজ করেই কাজ শুরু করেছি। এখন ভাটা করতে অনুমতি লাগেনা’।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক (যুগ্নসচিব) হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, ‘অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ভাটা চালু রাখতে সহযোগিতা করার বিষয়ে তদন্ত করা হবে। ইটভাটার পাহাড় কাটা ও বনের লাকড়ি পুড়ানোর বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ছবি ও তথ্য দেন। আমরা ব্যবস্থা নিব।’
স্থানীয়রা জানায়, ফাইতং ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডে গড়ে উঠা ২৮টি ইটভাটার সবগুলো ভাটা স্কুল, জনবসতী গ্রাম, সবুজ বনাঞ্চল, খালেরপাড় এবং সড়কের পাশে তৈরী করা হয়েছে। গেল বর্ষা থেকে শুরু করে ইটভাটা গুলো স্কেভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে যাচ্ছে। ভাটার একমাত্র কাঁচামাল মজুদ মাটি শেষ হওয়ায় নতুন করে আবারো ২৮টি ভাটা স্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটছে। যা দেখেও টিনের চশমা দিয়ে আছে পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান। ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধভাবে গড়ে উঠা ভাটার কারণে পাহাড়ের প্রকৃতির সীমাহীন ক্ষতি হচ্ছে অভিযোগ পরিবেশবাদীদের। এমনকি উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের পাগলীরছড়া থেকে শিবাতলী পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার জায়গায় গড়ে উঠেছে ২৮টি ইটভাটা। এবছর পাগলীরছড়া এলাকায় বিএমডব্লিউ এবং ফাদুরছড়া এলাকায় সেভেনবিএম নামে নতুন করে আরো দুইটি ইটভাটা সৃষ্টি হয়েছে।
ফাইতং মৌজা হেডম্যান উম্রামং মার্মা বলেন, ‘২০০৩ সালে ফাইতং ফাদুরছড়া এলাকায় দিদার মৌলভী ও সালে আহমদ নামে দুই ব্যক্তি ইউবিএম নামে একটি ভাটার মধ্য দিয়ে ইটভাটা কার্যক্রম শুরু করে। তারপর থেকে বাড়তে বাড়তে এখন ভাটা প্রায় ৩০টি। যদিও এবছর দুইটি ভাটা বন্ধ রয়েছে। এলাকায় যন্ত্রের গর্জন ও ধূলোবালুতে সবুজ প্রকৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। গত ২১ বছরে প্রায় দেড় শতাধিক পাহাড় হারিয়ে গেছে।’
শুধুমাত্র ফাইতং ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডে ২৮টি অবৈধ ইটভাটা থাকার কথা নিশ্চিত করেছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক বলেন, ‘কোন প্রকার অনুমতি, অনুমোদন ও ছাড়পত্র ছাড়াই বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে ২৮টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে।’
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুসারে লাইসেন্স ব্যতীত কোনো ইটভাটা স্থাপন, অবৈধ ইটভাটাগুলো কার্যক্রম শুরু এবং জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারের প্রস্তুতি গ্রহণ না করার আইন থাকলেও তা মানা হচ্ছেনা। বর্ষা ঋতুর পরপরই পাহাড়ে সবুজ প্রকৃতি সাজতে শুরু হলেও সেই পাহাড়ের বুকে আঘাত শুরু করেছে ইটভাটার মালিকরা।
ফাইতং ইউনিয়নের মেঅং পাড়ার বাসিন্দা চিংহ্লামং মারমা ও মংবাচিং মারমা বলেছেন, ‘শুধু এবছর নয়, কয়েক বছর ধরে কাটতে কাটতে পাড়ার পাশের পাহাড়টি এখন প্রায় শেষ হওয়ার পথে। তিনি আরো জানান, যেভাবে দিন-রাত অবিরাম কাটা হচ্ছে, তাতে কয়েকবছর পরে আর পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকবে না। পাহাড় কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করত। ইটভাটার মালিকেরা প্রভাবশালী। পাহাড় কাটতে বাধা দিলে তাঁরা মামলা-হামলার হুমকি দেন।’
লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ আরিফুল হক বেলাল জানিয়েছেন, ‘অবৈধ লাকড়ি পুড়ানোর বিষয়ে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। আজ বুধবার (১৩ মার্চ) ফাইতং সেভেনবিএম ইটভাটায় অবৈধ লাকড়ির বিষয়ে অভিযান চলছে।’
এবিষয়ে বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তর সহকারী পরিচালক মো. ফখর উদ্দিন চৌধুরী এর মুঠোফোনে অসংখ্যবার ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমি সদ্য যোগদান করেছি। অবৈধভাবে পাহাড় কাটার বিষয়ে ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।’
প্রসঙ্গত, লামা উপজেলায় ফাইতং ইউনিয়নে ২৮টি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ৭টি, গজালিয়া ইউনিয়নে ২টি, সরই ইউনিয়নে ১টি ও লামা পৌরসভায় ১টি ইটভাটা সহ মোট ৩৯টি অবৈধ ইটভাটা চালু রয়েছে।
সম্পাদকঃ এম. শাহীন আলম।। প্রকাশকঃ উম্মে হাবিবা
যোগাযোগ: ০১৬৪৭-৬২৭৫২৬/ ০১৮২৩-৯১৯০৯৫ whatsapp
parbattakantho@gmail.com
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
পার্বত্য কন্ঠ © ২০১৮-২০২৪ সংরক্ষিত