আজিমপুরের নাম উচ্চারিত হলে যূথবদ্ধ শব্দের মতো এসে জুড়ে বসে কবরস্থান শব্দটি। হবেই বা না কেন, রাজধানী এবং দেশের সবচেয়ে বড় কবরস্থান হিসেবে আজিমপুরের নাম সর্বাধিক পরিচিত। বাস্তবেও আয়তনের বিবেচনায় এ কবরস্থান সুবিশাল।
চারশত বছর আগের পুরনো কবরস্থান আজিমপুরের গোড়াপত্তন হয়েছে ঢাকা শহরের পত্তনের সূচনালগ্নেই। ধারণা করা হয়, সপ্তদশ শতকে রাজধানীর বুকে আজিমপুর কবরস্থান গড়ে ওঠে, যার বর্তমান আয়তন প্রায় সাড়ে ৭৪ বিঘা।
বর্তমানে আজিমপুর কবরস্থানটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। আগে সীমানা প্রাচীরের করুণ দশা এবং কবরের সারির মাঝে হাঁটার ভালো রাস্তা না থাকায় অনেকেই লাশ চুরির শঙ্কা, দাফন এবং জানাজা সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হতেন। বর্তমানে কবরস্থানের চারপাশে ১ হাজার ৬০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। দুই সারির কবরের পর পর চার ফুট চওড়া ফুটপাত তৈরি করা হয়েছে, যেখানে দাঁড়িয়ে সহজেই কবর জিয়ারত করা সম্ভব। জিয়ারত এবং হাঁটার সুবিধার জন্য এমন ১৬৮টি পথ তৈরি করেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
যেখানে আজিমপুর কবরস্থানের পরিবেশকে এতদিন অনেকটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই করা হতো। অনেকে না গিয়েই মনে করতেন, এটা অনেকটা বধ্যভূমি এবং গণকবর দেয়ার মতো জায়গা। অনেকে আবার ভাবতেন, এখানে শুধু কবর আর কবর, দাঁড়ানোর জায়গা অবধি নেই- তাদের ভুল ভাঙবে বর্তমান আজিমপুর কবরস্থানের শ্রীবৃদ্ধি দেখলে।
বিদেশ থেকে দাদার কবর জিয়ারত করতে আসা শাহরিয়ার সময় সংবাদকে বলেন,
‘যখন শুনেছিলাম দাদাকে আজিমপুরে কবর দেয়া হয়েছে, তখন এক রকমের রাগ করেই বাবা-চাচাদের বলেছিলাম, এত জায়গা থাকতে আজিমপুরে কেন? আমি ভাবতাম এখানকার পরিবেশ ভালো না। কিন্তু সরেজমিনে জিয়ারত করতে এসে ভুল ভাঙল। মালিদের কিছু টাকা দিলে তারা কবর পরিষ্কার করে রাখে। হাঁটার রাস্তাও বেশ ভালো।’
প্রতিদিন বিকেলে আজিমপুর হাঁটতে আসেন ষাটোর্ধ সোবহান হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখানে হাঁটার পরিবেশ খুব ভালো। পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সারিবদ্ধ কবরগুলো যখন চোখে পড়ে মনে হয় এই জীবনের প্রতি এত মোহমায়া দেখিয়ে কী লাভ! মানুষের মাঝেমধ্যে কবরস্থানে আসা উচিত। এতে দুনিয়ার লোভ-লালসা কমে আসবে।’
যারা কাজ করেন আজিমপুর কবরস্থানে:-
সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে, বিভিন্ন ধাপে ১ হাজারের মতো পরিচ্ছন্নতা কর্মী আজিমপুর কবরস্থানে কাজ করেন। এরা সবাই এখানকার স্থায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মী না। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে এনে নানা সময়ে এদের দিয়ে কবরস্থান পরিচ্ছন্নতার কাজ করানো হয়। চলতি বছর জুলাই মাসেও ডেঙ্গু মশার উপদ্রব রোধে প্রায় ১ হাজার ১০০ পরিচ্ছন্নতা কর্মীর মাধ্যমে এখানকার ঝোপঝাড় এবং আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়েছে।
এসব পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বাইরে আজিমপুরে কাজ করেন মালি, গোরখোদক এবং দাফনকারীরা। মালিদের কাজ কবর আগাছামুক্ত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। আর গোরখোদকরা মূলত লাশ এলে কবর খননের কাজ করে থাকেন। দাফনকারীরা লাশ দাফনের কাজে নিয়োজিত।
আজিমপুর কবরস্থানের ঠিকাদার বরকত হোসেন কল্লোল বলেন,দুই শিফটে গোরখোদক এবং দাফনকারীরা কাজ করে থাকেন। একটি শিফট সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা, অন্যটি দুপুর ২টা থেকে রাত ১১টা।
যারা কবর খননের কাজ করেন তারা মাটি দেয়া এবং লাশ দাফনের কাজ করেন না। এর জন্য আলাদা লোক আছে। দাফন এবং গোরখোদক মিলিয়ে ৯০ জনের একটি দল পালা করে কাজ করেন বলে জানান কল্লোল।
যেভাবে দাফন:-
আজিমপুর কবরস্থানের ইনচার্জ হাফিজুল ইসলাম বলেন, এখানে লাশ দাফন করতে হলে শুরুতে ১ হাজার টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। স্বভাবতই যারা লাশ দাফন করতে আসেন তারা বাঁশ-চাটাই নিয়ে আসেন না। বাঁশ-চাটাই বাবদ ঠিকাদারদের দিতে হয় ৮৬৫ টাকা। সে হিসেবে আজিমপুরে দাফন করতে চাইলে অফিসিয়ালি মোট খরচ পড়ে ১,৮৬৫ টাকা।
এ পরিমাণ অর্থ খরচ করলে কতদিন কবর থাকে জানতে চাইলে হাফিজ বলেন, এখানে কাউকে কবর দিলে এবং কবর সংরক্ষণ ফি দিলে ১৮ মাস কবর রাখা হয়। পরে কবর চালা করে আবার নতুন কবর তৈরি করা হয়।
তবে আজিমপুরের আশপাশের বাসিন্দারা বলেন,১৮ মাস সিটি করপোরেশনের কাগজে কলমে আছে। এখানে মালি এবং কর্মীদের টাকা না দিলে নির্ধারিত সময়ের আগেই কবর চালা করে লাশের হাড়-হাড্ডি সরিয়ে নতুন কবর তৈরি করা হয়।
এ ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে রবিউল বলেন, ‘আমার বাবার কবর এখানে। যদিও অফিসিয়াল খরচ ১,৮৬৫ টাকা, কিন্তু পরে কবর ১৮ মাস অবধি রাখতে চাইলে মালিদের খুশি রাখতে হয়। তাদের টাকা দিলে সহজে কবর ভাঙে না।’
এখানেও সিন্ডিকেট:-?
আজিমপুর কবরস্থানে লাশ দাফন করে কবরের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে মালি, গোরখোদক এবং দাফনকারীদের মধ্যে অঘোষিত এক সিন্ডিকেট কাজ করে। কবর টিকিয়ে রাখতে চাইলে এদের প্রতি মাসে টাকা দিতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন গোরখোদক বলেন,অনেকেই মুর্দারের আত্মীয়ের থেকে মাসিক টাকা-পয়সা নিয়ে থাকে। কেউ খুশি হয়ে গোরখোদকদের বখশিশ দিলে আলাদা কথা। অনেকে আবার বখশিশ না দিলে কবর খুড়তে চায় না, লাশ নামাতে চায় না। লাশ দাফনের পর মাসিক টাকা না দিলে ১৮ মাস হওয়ার আগেই লাশ তুলে ফেলে।
তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে টাকার অঙ্কের ওপর ভিত্তি করে লাশের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়। যারা টাকা বেশি দেয় তাদের লাশ সামনের দিকে ভালো জায়গায় দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। টাকা না দিলে যেখানে ফাঁকা থাকে সেখানেই লাশ দাফন হয়। তবে এগুলো সব কর্মচারীদের ভিতরগত সিন্ডিকেট।
লাশ দাফনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ইনচার্জ হাফিজুল বলেন, করোনার সময়ে এমনও হয়েছে যে, শুধু লাশ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, সঙ্গে কেউ আসেননি। সেই লাশ এখানকার কর্মচারীরা নিজেরা সযত্নে দাফন করেছেন। আজিমপুরে লাশ এলে সেটি সযত্নে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।
রিজার্ভ কবর:---
আজিমপুরে দাফন করা হয়েছে ভাষা শহীদ থেকে শুরু করে গণ্যমান্য অনেক ব্যক্তিকে। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথম দিকের কয়েকটি সারিতে চোখে পড়ে এদের কবর। এগুলোকে মূলত রিজার্ভ কবর বলা হয়। আগেকার নিয়ম অনুযায়ী, ৯৯ বছরের জন্য কবর রিজার্ভ করা যেত। বর্তমানে এটি বন্ধ রয়েছে। এখন চাইলেও স্থান সংকটের কারণে কবর রিজার্ভ দেয়া হয় না।
এ ব্যাপারে হাফিজুল বলেন, এখন সর্বোচ্চ ২৫ বছর মেয়াদে কবর সংরক্ষণ করা যায়। নতুন করে কবর রিজার্ভ দেয়া একেবারে বন্ধ। অনেকে মনে করেন আজিমপুর চাইলে কবরের জন্য জায়গা কেনা যায়। এটা ভুল ধারণা। আজিমপুরে সর্বোচ্চ কবর সংরক্ষণ করা যাবে, কিংবা নিয়ম মেনে একই কবরে অন্য আত্মীয়কে পুনঃদাফনের জন্য আবেদন করা যাবে। কিন্তু কবরের জমি নিজের মালিকানাধীন করে ফেলার কোনো নিয়ম আজিমপুরে নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনার তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর দক্ষিণাঞ্চলে সিটি করপোরেশনের আওতায় মোট ৪টি কবরস্থান রয়েছে। আজিমপুর, জুরাইন, মুরাদপুর এবং খিলগাঁও কবরস্থানে মোট ২৩ হাজার ৫৬০টি কবর রয়েছে। নথি অনুযায়ী, এসব কবরস্থানে এখন পর্যন্ত ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৮০০ জনকে কবর দেয়া হয়েছে।
সম্পাদকঃ এম. শাহীন আলম।। প্রকাশকঃ উম্মে হাবিবা
যোগাযোগ: ০১৬৪৭-৬২৭৫২৬/ ০১৮২৩-৯১৯০৯৫ whatsapp
parbattakantho@gmail.com
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
পার্বত্য কন্ঠ © ২০১৮-২০২৪ সংরক্ষিত