খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নে ১৬০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত মানিকছড়ি ডিসি পার্ক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই জায়গায় রয়েছে ৩টি সুবিশাল লেক, যার আয়তন প্রায় ৫ একর। এছাড়া রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ২২টি টিলা, যা পর্যটকের ক্লান্ত চোখে বুলায় আরাম-পরশ। এই টিলা-লেকবেষ্টিত জায়গাটিতে রয়েছে রাবারের বিশাল বাগান, আম-জাম-লিচু প্রভৃতি নানান প্রজাতির উদ্ভিদ। তাছাড়া, এখানে খুব ভোরে এবং সন্ধ্যায় খুব সহজেই চোখে পড়ে বানরের দল, বনমোরগ থেকে থেকে ডেকে উঠে, মথুরা-র মতো বর্ণিল পালকের পাখিসহ নানান জাতের টিয়া, শালিক, চড়ুই তো রয়েছেই। এক কথায়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জায়গায় রয়েছে মুগ্ধতা ছড়ানোর নানান উপাদান।
বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনার একটি দেশ। বর্তমান সরকার শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তিসহ সকল ক্ষেত্রেই রেখেছে পরিকল্পনা ও সফলতার ছাপ। জেলা ব্র্যান্ডিং এর মতো সৃজনশীল আইডিয়া নিয়ে সারা দেশে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান প্রশাসন। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনও এর ব্যতিক্রম নয়। পর্যটন-কে ব্র্যান্ড করে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খাগড়াছড়ির আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে নির্মিত হয়েছে দারুণ সব স্থাপত্য ও ঘটেছে নানান পজিটিভ পরিবর্তন, যা সারা দেশের ভ্রমণপ্রিয় মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তেমনি, বর্তমান জেলা প্রশাসনের আরেকটি লক্ষ্য- মানিকছড়ির অমিত সম্ভাবনাময় ডিসি পার্ককে আরো পর্যটন-বান্ধব, আরো প্রকৃতি-বান্ধব ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা। এরই ফলশ্রুতিতে অপরুপ সাজে সেজে চলেছে মানিকছড়ি ডিসি পার্ক।
ইতোমধ্যেই এই পার্কে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন তোরণ, স্থানীয় সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকে ধারণ করে নির্মাণ করা হয়েছে ট্যুরিস্ট সেন্টার ও ওয়াশ ব্লক। এখানে নির্মিত ট্রি-হাউজ, লেকের পাড়ে নির্মিত ২টি গোলঘর, আকাবাকা সিড়ি দিয়ে লেকে নামার রাস্তা, লেকপাড়ে হাটার ওয়াক-ওয়ে ঘুরতে আসা লোকজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিকেল অস্তগামী সূর্যের ছটা উপভোগের জন্য রয়েছে সানসেট পয়েন্ট *গোধূলী*। লেকের পানিতে ঘোরার জন্য নৌকা ছাড়াও এখানে রাত্রিযাপনের জন্য রয়েছে ২ রুম বিশিষ্ট একটি রিসোর্ট, *অরণ্য কুটির*। এক কথায়, নানান ধরণের পর্যটন-বান্ধব স্থাপনা ও সুবিধাতে সেজে উঠছে 'মানিকছড়ি ডিসি পার্ক'।
এইসকল সুযোগ-সুবিধার সাথে এই পার্ককে আরো আকর্ষণীয়, আরো পর্যটন-বান্ধব ও প্রকৃতি-বান্ধব করার জন্য বর্তমান জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নেতৃত্বে মানিকছড়ি উপজেলা প্রশাসন বাস্তবায়ন করছে 'বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি-২০২৩ আও ডিসি পার্কের ২০ একর জায়গাজুড়ে ঘোষণা করা হচ্ছে 'পাখির অভয়ারণ্য'।
বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ঃ- মানিকছড়ি ডিসি পার্কে নানান জাতের গাছ-লতাগুল্ম থাকলেও ছিলো না কোন সুন্দর পরিকল্পনা। তাই, এই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আওতায় বন বিভাগ, কৃষি বিভাগের সহায়তায় উপজেলা প্রশাসন, মানিকছড়ির নেতৃত্বে পরিকল্পিত উপায়ে লাগানো হচ্ছে প্রায় ১০০ প্রজাতির ২৫ হাজার গাছের চারা। ফলদ, বনজ, শোভাবর্ধক, ঔষধি ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতির চারা জোগাড় করা হয়েছে দেশের নানান প্রান্ত থেকে। ইতোমধ্যে ১০ হাজারের বেশি গাছের চারা লাগানোর কাজ সম্পন্ন।
ফলদ গাছের মধ্যে কাগজিলেবু, জাম, পেয়ারা, কাঠাল, জলপাই, মাল্টা, জাম্বুরা, আমড়া, কদবেল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, এখানে যেহেতু ঘোষিত হতে যাচ্ছে *পাখির অভয়ারণ্য*, সেটাকে মাথায় রেখে রোপণ করা হচ্ছে ডেউয়া, ডুমুর, গাব, করমচা, লটকন, কামরাঙা প্রভৃতি। এই সকল গাছের ফল মূলত পাখিদের খুব পছন্দ।
বনজ গাছের মধ্যে রয়েছে গর্জন, চিকরাশি, চাপালিশ, কাঠবাদাম প্রভৃতি। মানিকছড়ি ডিসি পার্ক যেহেতু পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে, তাই এখানে পরিকল্পিত উপায়ে লাগানো হচ্ছে নানান শোভাবর্ধক গাছের চারা, যেমনঃ কৃষ্ণচুড়া, রাধাচূড়া, জারুল, জাকারান্ডা, সোনালু, কাঞ্চন, কদম প্রভৃতি। হাটার রাস্তার পাশে এইসকল গাছের বিস্তৃত সরণি ভবিষ্যতে ভ্রমণ-পিপাসু মানুষকে যেমন আকৃষ্ট করবে, তেমনি এখানে কাটানো সময়কে করবে স্মরণীয়।
ঔষধি গাছ সারা বাংলাদেশেই এখন দুর্লভ। তাই, মানিকছড়ি ডিসি পার্কে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম *ঔষধি টিলা*। এখানে দুর্লভ প্রায় ২০ প্রজাতির ঔষধি গাছ লাগানো হচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতমঃ অর্জুন, আমলকি, বহেরা, হরিতকি, নিম, অশোক প্রভৃতি। এছাড়া, এখানে প্রায় ৫ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের একটি জোন, যেখানে থাকবে রিটা, উরি আম, তমাল, কর্পুর, মান্দার, লোহা কাঠ, ওরা বাঁশ, মহুয়া, বন সোনালু, বক্স বাদাম, নাগেশ্বর, নাগলিঙ্গম, কনকচূড়া, বুদ্ধ নারিকেল, রকতন, টক পেয়ারা, করসাল, জায়ফল প্রভৃতি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির গাছ। এই অংশটি তাই শুধু পর্যটক নয়, বিভিন্ন গবেষণাধর্মী কাজে ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও বন গবেষণায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
পাখির অভয়ারণ্যঃ-
মানিকছড়ি ডিসি পার্ক এক অনন্য প্রাকৃতিক নিসর্গের স্থান। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক হওয়ায় ও জনবসতি না থাকায় এতে দেখা মেলে বনমোরগ, মথুরা, শালিক, টিয়া, আরো হরেক রকম পাখ-পাখালির। কিন্তু, সারা বাংলাদেশের মতো এখানেও রয়েছে পাখির যথাযথ প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব এবং আশেপাশের মানুষজনের অজ্ঞানতাবশত শিকারের মানসিকতা। এইসকল দিক চিন্তা করে, নিরাপদ পাখির আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলার ডিসি পার্কের ২০ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে 'পাখির অভয়ারণ্য'।
এই উদ্দেশ্যে ডিসি পার্কের বিভিন্ন গাছে সুবিধাজনক জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে ১০০টি 'মাটির হাড়ি 'পাখির বাসা। এই বাসাগুলো পাখিদের আকৃষ্ট করবে এবং নিরাপদবোধ করলে অন্যান্য পাখিও এখানে থাকবে। তাছাড়া, পূর্বে উল্লেখিত *বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি*তে গাছের চারা বাছাই করার সময় মাথায় রাখা হয়েছে পাখিদের খাবার সংস্থানের বিষয়টি। এতে যেমন গাছের প্রজাতিতে বৈচিত্র্য এসেছে, তেমনি দেশীয় জাতের গাছ রোপণ করা হয়েছে, যাদের ফল বাংলাদেশের পাখিদের স্বাভাবিক ও পছন্দের খাবার । পাখি-বান্ধব গাছের মধ্যে ডেউয়া, ডুমুর, গাব, আমলকি, কামরাঙা, লটকন, জাম, মহুয়া, টক পেয়ারা, লুকলুকি, শরিফা অন্যতম। সারা বছর যাতে পাখিদের- বন্য প্রাণিদের খাবার যোগান দিতে পারে এই সকল গাছে, তেমনিভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে। আশা করা যায়, অচিরেই নতুন নতুন পাখ-পাখালির কুজনে মুখরিত হয়ে উঠবে এই ডিসি পার্ক। তবে, শুধু গাছ লাগানোতেই এই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণার কাজ শেষ নয়, বলা যায় শুরু মাত্র। এই সকল গাছের সুষ্ঠু পরিচর্যা ও বৃদ্ধির বিষয়েও রয়েছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। তাছাড়া, অভয়ারণ্য এলাকায় মানুষ চলাচল নিয়ন্ত্রণের বিষয় রয়েছে। মানুষ যাতে পাখি শিকার না করতে পারে, তার জন্যে প্রশিক্ষিত জনবল স্থানীয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী থেকে বাছাই করা হবে, যা কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে। যারা পাখি শিকার করে, তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ট্যুর গাইড হিসেবে তাদের প্রশিক্ষণের পর নিয়োগ দেওয়া যাবে। এছাড়া, এই ডিসি পার্কে অচিরেই জেলা প্রশাসন-বিভাগীয় প্রশাসন, পর্যটন মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় জিপলাইন, জায়ান্ট সুইং, আর্চারি পয়েন্ট প্রভৃতি এডভেঞ্চার একটিভিটি চালু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ড্র-ব্রীজের মাধ্যমে লেকগুলোকে যুক্ত করে যোগ করা হবে লেকে কায়াকিং এর সুবিধা। ভবিষ্যত পর্যটনের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে ক্যাম্পিংসহ আবাসন সুবিধা আরো বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার, ইকো-ট্যুরিজম নির্ভর জঙ্গল সাফারি প্রভৃতি একটিভিটি সুসম্পন্ন হলে রাঙামাটির সাজেকের মতোই এই স্থান সারা বাংলাদেশে অনন্য নামে পরিচিত হবে এবং এতে স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে বহুগুণ, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করা পাশাপাশি দেশের পর্যটন অর্থনীতিকেও বেগবান করবে বলে প্রকৃতিপ্রেমিদের ধারণা।
সম্পাদকঃ এম. শাহীন আলম।। প্রকাশকঃ উম্মে হাবিবা
যোগাযোগ: ০১৬৪৭-৬২৭৫২৬/ ০১৮২৩-৯১৯০৯৫ whatsapp
parbattakantho@gmail.com
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
পার্বত্য কন্ঠ © ২০১৮-২০২৪ সংরক্ষিত