এর পরে তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী এবং তিন দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তুরস্ক যখন বিধ্বংসী ভয়াবহ ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় মোকাবেলার চেষ্টা করছে, তখনই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে এই কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ পার করে আবারও সফল হয়েছেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে তুরস্কে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গৃহহীন হয়েছে ১৫ লাখের বেশি। এছাড়াও রয়েছে তুরস্কের টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠেছে। এমন অবস্থার মধ্যে এবারের নির্বাচন ছিল এরদোয়ানের জীবনের সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ও সাবেক ফুটবলার রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুল শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়ে চলে আসেন রাজনীতির সম্মুখ সারিতে।
রাজধানী আঙ্কারা থেকে সাংবাদিক সরওয়ার আলম (যিনি তুরস্কের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন) বলেন, ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা সমাধান করে তিনি প্রথমে ওই শহরে এবং পরে সারাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন।
তিনি বলেন, 'আবর্জনা সমস্যা, বিদ্যুৎ সংকট, পানির সমস্যাসহ আরও যত ধরনের সমস্যা ছিল সেগুলো সমাধানের জন্য মেয়র এরদোয়ান আন্তরিকভাবে কাজ করেন। পরবর্তীকালে তুরস্কের রাজনৈতিক সমস্যা থেকেও তিনি সুবিধা পেয়েছেন। তৎকালীন জোট সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ার পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে তিনি মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যেকোনও একটি দল এককভাবে সরকার গঠন করলে দেশকে আরও স্থিতিশীলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।'
এই প্রচারণায় সফল হন এরদোয়ান এবং ২০০৩ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এর পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গত ২০ বছর ধরে তিনি দেশটির ক্ষমতায় আসীন।
দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তুরস্কের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বদলে দিয়ে আরও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন এরদোয়ান। আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পর অন্য যেকোনও নেতার চেয়ে তিনিই দেশটিকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছেন।
মুসলিম মূল্যবোধের পক্ষে সরাসরি বক্তব্য দেওয়ার কারণেও এরদোয়ান বহু তুর্কীর কাছে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তার নেতৃত্বে ইসলামপন্থী দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা একেপি ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে তুষ্ট করার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করে।
চার সন্তানের পিতা এরদোয়ান জন্ম-নিয়ন্ত্রণের সমালোচনা করেন। যাদুঘর থেকে আয়া সোফিয়াকে ফের মসজিদে রূপান্তরিত করেন। ক্ষমতায় আসার আগেও এক সমাবেশে জাতীয়তাবাদী একটি কবিতা পড়ার জন্য তার চার মাসের জেল হয়েছিল। এই কবিতার কয়েকটি লাইন ছিল এরকম, 'মসজিদ আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনারগুলো আমাদের বেয়নেট এবং বিশ্বাস হলো আমাদের সৈন্য।'
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বহির্বিশ্বের সামনেও তার সামরিক পেশিশক্তি প্রদর্শন করেছেন। লিবিয়া ও সিরিয়া যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশ নিয়েছেন। ন্যাটোর সদস্য দেশ হওয়া স্বত্বেও তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের জন্য তিনি মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়েছেন। শস্য রফতানির বিষয়ে যুদ্ধরত দুটো দেশের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতেও সফল হয়েছেন।
পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিরক্ষা জোট নেটোতে যোগ দেওয়ার জন্য সুইডেন ও ফিনল্যান্ড যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তুরস্ক তাতেও বাধা দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এরদোয়ানের এই পেশি-সুলভ কূটনীতি লক্ষ্য করা গেছে ইউরোপের বাইরেও। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তার এই সামরিক শক্তি প্রদর্শন এরদোয়ানকে দেশের ভেতরে জনপ্রিয় করেছে বলে মনে করেন আলী রীয়াজ।
একনজরে এরদোয়ান
এরদোয়ান ১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের কাছিমপাশা শহরতলীতে আহমদ এরদোয়ান ও তানজিলে হানিম দম্পতির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আহমদ এরদোয়ান পেশায় একজন জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন। পাঁচজন সহোদরের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
এরদোয়ান তার জন্ম সম্পর্কে বলেন, আমার আসল এলাকা 'রিজে'। তবে আমার জন্ম কাছিমপাশায় ১৯৫৪ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি।
পিয়ালেপাশা শহরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করেন এরদোয়ান। ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে তিনি এখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং ইমাম হাতিব স্কুলে ভর্তি হন। ইমাম হাতিব স্কুল থেকে দ্বাদশ শ্রেণী সমাপ্ত করে তিনি আয়্যুব কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৩ সালে তিনি ব্যবসায় শিক্ষা ও অর্থনীতি ইন্সটিটিউটে নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে উত্তীর্ণ হয়ে এখানে পড়ালেখা সমাপ্ত করেন।
প্রাথমিক জীবন
ইতিহাসবিদ এম. হাকান ইয়াভুজের মতে, এরদোয়ানের জন্ম গুনেইসু, রিজে এবং পরে তার পরিবার ইস্তাম্বুলের একটি দরিদ্র পাড়া কাসিম্পাসায় চলে আসে। এরদোয়ানের শৈশব কাটে রিজে। সেখানে তার বাবা ছিলেন তুর্কি কোস্ট গার্ডের একজন ক্যাপ্টেন। তার গ্রীষ্মের ছুটিগুলোর বেশিরভাগই কাটত গিনিসু, রিজে। যেটি ছিল তার পরিবারের স্থায়ী বাসস্থান। সারা জীবনে তিনি মাঝে মাঝেই এই বাড়িতে ফিরে আসেন । ২০১৫ সালে তিনি এই গ্রামের কাছে একটি পাহাড়ের চূড়ায় একটি বিশাল মসজিদ তৈরি করেছিলেন। এরদোয়ানের বয়স যখন ১৩ বছর তখন তার পরিবার ইস্তাম্বুলে ফিরে আসে।
কিশোর বয়সে, এরদোয়ানের বাবা তাকে সাপ্তাহিক ভাতা ২.৫ তুর্কি লিরা দিতেন, যা এক ডলারেরও কম। এটি দিয়ে এরদোয়ান পোস্টকার্ড কিনে রাস্তায় পুনরায় বিক্রি করেতেন। এছাড়াও,যানজটে আটকে থাকা চালকদের কাছে তিনি পানির বোতল বিক্রি করেছেন। এরদোয়ান হকার হিসেবে সিমিট (তিলের রুটির আংটি) বিক্রি করতেন। তিনি একটি সাদা গাউন পরতেন এবং একটি লাল তিন চাকার গাড়ি থেকে সিমিট বিক্রি করতেন, গাড়িটির উপরের অংশ ছিল কাঁচে ঘেরা।
যৌবনেকালে এরদোয়ান একটি স্থানীয় ক্লাবে আধা-পেশাদার হিসেবে ফুটবল খেলতেন। ফেনারবাহচে তাকে ক্লাবে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার বাবা তাতে বাধা দেন। যে জেলার স্থানীয় ফুটবল ক্লাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন সেটির নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। ক্লাবটির বর্তমান নাম কাসিম্পাসা এসকে।
এরদোয়ান ইস্কেন্দারপাসা সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। ইস্কেন্দারপাসা সম্প্রদায় হলো নকশবন্দী তরিকার একটি তুর্কি সুফিবাদী সম্প্রদায়।
শিক্ষা
এরদোয়ান ১৯৬৫ সালে কাসিম্পাসা পিয়ালে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং ১৯৭৩ সালে ইমাম হাতিপ স্কুল (একটি ধর্মীয় বৃত্তিমূলক উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে স্নাতক পাস করেন। একে পার্টির অন্যান্য সহ-প্রতিষ্ঠাতারাও একই শিক্ষাগত পথ অনুসরণ করেছিলেন। ইমাম হাতিপ স্কুলের পাঠ্যক্রমের এক চতুর্থাংশ পবিত্র কোরআন, মহানবী হযরত মুহাম্মদের জীবন এবং আরবি ভাষা বিষয়ে। এরদোয়ান একজন ইমাম হাতিপের কাছে কোরআন অধ্যয়ন করেন, সেখানে তার সহপাঠীরা তাকে 'হোজা' (মুসলিম শিক্ষক)বলে ডাকতেন।
এরদোয়ান জাতীয়তাবাদী ছাত্র গোষ্ঠী ন্যাশনাল তুর্কি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (মিলি তুর্ক তালেবে বির্লিগি ) এর একটি সভায় যোগদান করেন। এরদোয়ান তার বাগ্মী দক্ষতার দ্বারা আলাদা নজর কেড়েছিলেন। জনসাধারণকে কথা শুনার জন্য একটি ঝোঁক তৈরি করেছিলেন। শ্রোতাদের সামনে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত বক্তা। তিনি তুর্কি প্রযুক্তিগত চিত্রশিল্পীদের সম্প্রদায় দ্বারা আয়োজিত একটি কবিতা-পঠন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং পাঠ ও গবেষণার মাধ্যমে বক্তৃতার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। এরদোয়ান পরে এই প্রতিযোগিতাগুলোকে 'জনতার সামনে কথা বলার সাহস বাড়ায়' বলে মন্তব্য করেন।
এরদোয়ান মেকতেব-ই মুলকিয়েতে উন্নত পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, মুলকিয়ে শুধুমাত্র নিয়মিত হাই স্কুল ডিপ্লোমাধারী ছাত্রদের গ্রহণ করত, ইমাম হাতিপ স্নাতকদের গ্রহণ করত না। মেকতেব-ই মুলকিয়েত তার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের জন্য পরিচিত ছিল, যেটি তুরস্কের অনেক রাষ্ট্রনায়ক এবং রাজনীতিবিদদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। এরদোয়ান তখন ইয়ুপ হাই স্কুল (একটি নিয়মিত রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়) এ ভর্তি হন এবং সেখান থেকে তার হাইস্কুল ডিপ্লোমা লাভ করেন।
তার সরকারী জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি পরবর্তীতে আকসারায় স্কুল অফ ইকোনমিক্স অ্যান্ড কমার্শিয়াল সায়েন্সেসে ব্যবসায় প্রশাসন অধ্যয়ন করেন। এটি এখন মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও প্রশাসনিক বিজ্ঞান অনুষদ হিসাবে পরিচিত। বিতর্ক রয়েছে যে, তিনি স্নাতক হননি।কারন তার স্নাতক সার্টিফিকেট কখনোই উপস্থাপন করা হয়নি।
পরিবার
এরদোয়ান ৪ জুলাই ১৯৭৮ সালে এমিন গুলবারানকে বিয়ে করেন। এমিন গুলবারান ১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের দুই ছেলে আহমেত বুরাক (জন্ম ১৯৭৯) এবং নাজমুদ্দিন বিলাল (জন্ম ১৯৮১)। এছাড়াও দুই মেয়ে এসরা (জন্ম ১৯৮৩) এবং সুমেয় (জন্ম ১৯৮৫)। তার বাবা আহমেত এরদোয়ান ১৯৮৮ সালে মারা যান এবং তার মা তেনজিল এরদোয়ান ২০১১ সালে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান।
এরদোয়ানের একজন ভাই এবং এক বোন রয়েছে। ভাই মুস্তাফা ১৯৫৮ সালে ও বোন ভেসিলে ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
জাতীয়বাদি কবিতা আবৃত্তির জন্য ১৯৯৯ সালে জেল খাটেন এরদোয়ান। এর জন্য মেয়র পদও ছাড়তে হয় তাকে। তার সাজার সময়কাল ছিল ২৪ মার্চ ১৯৯৯ থেকে ২৭ জুলাই ১৯৯৯।
তাকে কির্কলারেলির পিনারহিসার কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছিল। যেদিন এরদোয়ান কারাগারে যান, তিনি দিস গান ডোজন্ট এন্ড হিয়ার নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন। অ্যালবামটিতে সাতটি কবিতার একটি ট্র্যাকলিস্ট রয়েছে এবং এটি ১৯৯৯ সালে তুরস্কের সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবাম হয়ে ওঠে।
২০১৩ সালে (জেল খাটার ১৪ বছর পর) এরদোয়ান পিনারহিসার কারাগার পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের পরে তিনি বলেন 'আমার জন্য, পিনারহিসার হল পুনর্জন্মের প্রতীক, যেখানে আমরা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।' সূত্র: বিবিসি ও উইকিপিডিয়া
পার্বত্যকন্ঠ নিউজ/এমএস
সম্পাদকঃ এম. শাহীন আলম।। প্রকাশকঃ উম্মে হাবিবা
যোগাযোগ: ০১৬৪৭-৬২৭৫২৬/ ০১৮২৩-৯১৯০৯৫ whatsapp
parbattakantho@gmail.com
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
পার্বত্য কন্ঠ © ২০১৮-২০২৪ সংরক্ষিত