বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে রুমায় ১০টি ও রোয়াংছড়িতে ২িটি স্কুলের অবস্থান। রুমার গহীন পাহাড়ে যৌথবাহিনীর অভিযান চলাকালে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলির আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত। এ জন্য ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গত বছর অক্টোবর মাস থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার হিল ফিন্দাল শ্বারকীয়া’ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে সেনা ও র্যাবের যৌথ বাহিনী। মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। মূলত ভয় ও আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে না আসায় স্কুলগুলো বন্ধ রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানায়।
রুমা উপজেলায় বন্ধ থাকা এই ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো হল- পাইন্দু ইউনিয়নের মুয়ালপি পাড়া, আরথাহ পাড়া, বাসত্লাং পাড়া এবং মুননুয়াম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের পাকনিয়ার পাড়া, কেসপাই, স্লোপি পাড়া, চাইংক্ষ্যং পাড়া, এলিন চান্দালা পাড়া ও ঞাংক্ষ্যং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের রনিন পাড়া ও পাইনক্ষ্যং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
রুমা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আশীষ চিরান বলেন, বন্ধ থাকা ১০টি স্কুলের মধ্যে রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের পাকনিয়ার ও কেসপাই স্কুলে ডিসেম্বর থেকেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যায়। ফলে স্কুল দুটি একবার বন্ধ হয়, একবার খোলা হয় অবস্থার মধ্যে ছিল। জানুয়ারি পর্যন্ত নতুন বইও বিতরণ করা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ‘রেমাক্রি প্রাংসা’ ইউনিয়নের এই দুটি স্কুলই বেশি দুর্গম এলাকায়। উচুঁ নিচু পাহাড় বেয়ে হাঁটার পথই স্কুল যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। পাকনিয়ার স্কুলে শিক্ষার্থীরা সংখ্যা আগে বেশি ছিল। বর্তমানে মাত্র ১৬-১৭ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এমনিতেই কম। এলাকায় বিরূপ পরিস্থিতির পর শিক্ষার্থীর উপস্থিতি সংখ্যা আরও কমে যাওয়ায় একেবারে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। বাকি ৪টি স্কুল এলাকার পরিস্থতি স্বাভাবিক হলে খোলা হয়। খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হলে আবার বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষকরা ক্লাস নিতে আগ্রহী। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থী না আসায় স্কুলটি ‘অটো বন্ধ’ হয়ে যায়। মাঝখানে পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় মুয়ালপি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আরথাহ্ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাস ত্লাং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন আগেও ক্লাস হয়েছিল। এখন আবার বিরূপ পরিস্থিতির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আশীষ চিরান।
স্কুল বন্ধের বিষয়ে রুমা বাজার সাপ্তাহিক বাজার দিনে বেশ কয়েকটি পাড়াবাসীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম না প্রকাশের শর্তে রুমায় সাপ্তাহিক বাজারে আসা কয়েকজন অভিভাবক বলেন, এলাকায় খারাপ পরিস্থিতির কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে সবাই ভয় পাচ্ছে। এ কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে সবাই। সামর্থ্যবান কেউ কেউ এলাকায় বিরূপ পরিস্থিতি হওয়ার পর থেকে ছেলেমেয়েদের উপজেলা সদর ও জেলা শহরে নিয়ে এসে লেখাপড়া করাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ জুম চাষিদের ছেলেমেয়েকে এলাকার বাইরে পাঠিয়ে লেখাপড়া করানোর সামর্থ্য নেই। এখন তারাই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এমনিতে দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা নানা কারণে লেখাপড়ায় দুর্বল। তার মধ্যে আবার স্কুল বন্ধ। এলাকায় রয়েছে চাপা আতঙ্ক। সবকিছু মিলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার করার ক্ষেত্রে বড় ধরণের ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কোনো বিকল্প উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে ক্ষতি মেনে নিতে হচ্ছে। পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হয় তাও বলা যাচ্ছে না। অভিযান চালানোর আগে কিছু দুর্গম এলাকায় জীপ গাড়ি যেত এখন অভিযানের পর থেকে এলাকায় নিরাপত্তার কারণে যানবাহন না থাকায় বাজারে তিন ঘণ্টার পথ পায়ে হেঁটে আসতে হয় বলে জানিয়েছেন কয়েকজন পাড়াবাসী।
রুমা উপজেলা চেয়ারম্যান উহ্লাচিং মারমা বলেন, এলাকাবাসীরা তাকে জানিয়েছেন সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। মূলত শিক্ষার্থীরা স্কুলে না আসার কারণে স্কুলগুলো বন্ধ রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের উপজেলায় মাসিক সমন্বয় সভাতেও ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
সভায় উপজেলা শিক্ষা বিভাগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, যেহেতু সন্ত্রাস ও জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, সে কারণে মাঝে মধ্যে যৌথবাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি হওয়ায় আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে ভয় পাচ্ছে। যার কারণে এই ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে।
এদিকে স্কুল বন্ধ থাকার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন রুমা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মামুন শিবলী।
কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামে পাহাড়ের একটি সশস্ত্র দলের তৎপরতার খবর বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচনায় আসছিল। পাহাড়িরা কেএনএফ সংগঠনটিকে ‘বম পার্টি’ নামে চেনে। নিজেদের তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর জনজাতিগুলোর ‘প্রতিনিধিত্বকারী’ হিসেবে তুলে ধরে।
এ সংগঠন ‘কুকি-চিন রাজ্যে’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চায়; যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না, থাকবে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে গত অক্টোবরে সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র্যাব।
জঙ্গিদের এ তথ্য পাওয়ার ওই সময় থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলায় যৌথ অভিযান চালাচ্ছে র্যাব ও সেনা সদস্যরা। পরে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও। যৌথ বাহিনীর এ অভিযানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা থেকে এ পর্যন্ত নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৩৫ জন সদস্য এবং কেএনএফের পাহাড়ে যারা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত তাদের ১৭ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে অভিযানের পর থেকে বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি ও আলীকদম চারটি উপজেলায় দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয় স্থানীয় প্রশাসন। দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর পর তিনটি উপজেলা থেকে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও রুমা উপজেলায় এখনও অনির্দিষ্টকালের জন্য পর্যটক ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এম/এস
সম্পাদকঃ এম. শাহীন আলম।। প্রকাশকঃ উম্মে হাবিবা
যোগাযোগ: ০১৬৪৭-৬২৭৫২৬/ ০১৮২৩-৯১৯০৯৫ whatsapp
parbattakantho@gmail.com
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
পার্বত্য কন্ঠ © ২০১৮-২০২৪ সংরক্ষিত