বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গে পাকিস্তানের অর্থনীতির তুলনা করে সম্প্রতি বিশ্লেষণধর্মী একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল। তাতে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা ও অর্থনীতির। ইংরেজি থেকে অনূদিত নিবন্ধটি হুবহু নিচে তুলে ধরা হলো।
সামাজিক খাতে অর্থবহ বিনিয়োগ ব্যতিরেকে দারিদ্র্যের সমাধান করা যায় না, কারণ এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করে। প্রবৃদ্ধি ছাড়াও সামাজিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ দারিদ্র্য হ্রাসে সমান গুরুত্বপূর্ণ— যেমন বাংলাদেশ থেকে প্রমাণিত হয় যে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও সেখানে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে।
দুই দশক আগেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন মাথাপিছু আয় এবং মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) স্বল্প প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো। কিন্তু এখন আমাদের চেয়েও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেশি এবং ভারতের পর বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হলো বাংলাদেশ।
দুই বছর ধরে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় কমছে। এমনকি সংঘাতকবলিত আফগানিস্তানের চেয়েও আমাদের মাথাপিছু আয়ে প্রবৃদ্ধি কম। সামাজিক খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নারী স্বাধীনতা। সামাজিক খাতে বিনিয়োগের অর্থ শুধু উচ্চ হারে বরাদ্দ নয়, এই সংস্থানগুলোর বিচারিক ব্যবহারও অপরিহার্য।
বিদ্যমান সরকারি স্কুলগুলো যদি বেসরকারি স্কুলগুলোর মতো জ্ঞান দেয়া শুরু করে তবে আমাদের অতিরিক্ত স্কুলগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের বেশিরভাগ সরকারি বিদ্যালয়ে নিম্নমানের শিক্ষা দেয়া হয়। যেগুলো কেবল দরিদ্রদের শিক্ষা প্রদান করে। এর মাধ্যমে আমরা বৈষম্যমূলক দুটি পৃথক সমাজ তৈরি করছি।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা সরকারি বিদ্যালয়ে পড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর চেয়ে বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনে অতিরিক্ত মাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। তারা হয় বেশি আধুনিক। এ অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষায় তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে এবং পাকিস্তানে সেই সংখ্যা সবচেয়ে কম।
ভালো বেতনে ‘মানসম্পন্ন’ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সত্ত্বেও সরকারি স্কুলগুলোর এ হাল অনেক দিন ধরেই। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে না পারার কারণে শিক্ষায় সরকারের ব্যয় করা কোটি কোটি টাকা মূলত গচ্চা যাচ্ছে। ফলে শিক্ষাখাতে প্রচুর ব্যয় করেও শিক্ষার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এই অঞ্চলে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে। নিরক্ষর লাখ লাখ তরুণ-যুবক প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। বেশিরভাগই দিনমজুরের কাজ করে। যখন অর্থনীতির গতি থাকে তখন নিয়মিত কাজ থাকে কিন্তু শ্লথগতি দেখা দিলে, যেমন এখন বেশিরভাগের কোনও চাকরি ও কাজ নেই।
বাংলাদেশের চেয়ে আমাদের ডাক্তার, নার্স এবং প্যারামেডিকেল কর্মী সেই সঙ্গে দেশে সরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালের সংখ্যা বেশি থাকতে পারে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু তিন বছর বেশি। এ ছাড়া বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার পাকিস্তানের তুলনায় অর্ধেক।
এ ছাড়া বাংলাদেশ একটি পোলিওমুক্ত দেশ এবং বিশ্বের যে দুটি দেশে এখনও পোলিও রোগটি রয়েছে পাকিস্তান এর মধ্যে একটি। সম্প্রতি ডব্লিউএইচও নাইজেরিয়াকেও পোলিওমুক্ত ঘোষণা করেছে। আমাদের সরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মান খারাপ। ফলে দ্রুত ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা।
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় অনেক বেশি এবং সমাজের বিত্তবানরাই শুধু এ সুবিধা পান। শিক্ষাখাতে যেমন দুটি পৃথক সমাজ তৈরি হয়েছে, পাকিস্তানে ঠিক তেমনি স্বাস্থ্যখাতেও তৈরি হয়েছে এ বিভাজন। ফলে বিত্তবানরা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সুস্থ থাকছেন আর দরিদ্র মানুষ ভুগছেন মারাত্মক এক স্বাস্থ্য সংকটে।
বাংলাদেশ সামাজিক অগ্রগতির সঙ্গে অর্থনৈতিক নৈরাশার সংমিশ্র ঘটিয়েছে। এ অঞ্চলের যে কোনো দেশের চেয়ে নারীদের মর্যাদা উন্নয়ন ও অধিকার সংরক্ষণে সবচেয়ে বেশি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। ক্ষুদ্রঋণ দেয়া হয় মূলত নারীদের। এ ছাড়া সফলভাবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ।
এতে শুধু শিশু মৃত্যুহারই কমেনি, বেড়েছে নারীর মর্যাদাও। পরিবারের মধ্যে নারী সদস্যদের ভূমিকা আরও বেড়েছে। পরিবারের আকার কেমন হবে তার নিয়ন্ত্রণও এখন বাংলাদেশের নারীদের হাতে। এদিকে পাকিস্তান শুধু মুখে মুখে লিঙ্গ সমতার কথা বলছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলে পাকিস্তানেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ।
নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের যে উত্থান শুরু হয়, তাতে যেসব শ্রমিক কাজ করেন তাদের ৮০ শতাংশই নারী। এতে দেশটিতে নারীদের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে আয়ও বেড়েছে। বাংলাদেশে পুরুষদের চেয়ে নারীরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাবার ও শিশুর কল্যাণে বেশি ব্যয় করে। পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বাংলাদেশে সরকার ছাড়াও বড় বড় বেসরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে পাকিস্তানে দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় কর্মসূচিগুলো পরিচালিত হয় বেনজির ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম, এহসাস আর পাকিস্তান দারিদ্র্য বিমোচন তহবিলের মাধ্যমে।
এক দশক আগে বাংলাদেশের সামাজিক সাফল্য তার অর্থনৈতিক সাফল্যের চেয়ে বেশি ছিল। সামাজিক ক্ষেত্রের ব্যয়ের কারণে তৈরি হওয়া মানবসম্পদ সেই দেশকে এখন টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে ধাবিত করছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু দুই দশক আগেও যা তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশের মতো একটি দেশ প্রমাণ করেছে যে, অনেক প্রবৃদ্ধির জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধু দরকার গৃহীত নীতির প্রতি আস্থা রেখে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার মনোভাব।