নাব্যতা সংকটে পদ্মা নদীর দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় আটকা পড়ছে পন্যবাহি কার্গো জাহাজ। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এসকল জাহাজ থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাহিদা মত চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে মারধরের শিকার হচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দৌলতদিয়া-বাঘাবাড়ী নৌরুটে নাব্যতা সংকটের কারণে কয়েকদিন ধরে পন্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। পাথর, কয়লা, গম, সারসহ বিভিন্ন পন্য বোঝাই এ সকল কার্গোজাহাজ গুলো চট্রগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে ছেড়ে এসে পদ্মা নদীর দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় আটকা পড়ছে। পরে এখান থেকে আংশিক পন্য খালাস করে ছোট কার্গো বা ট্রলারে বাঘাবাড়ী পাঠানো হচ্ছে। এরপর লোড কমিয়ে কার্গোগুলো বাঘাবাড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে। পন্যবাহি প্রতিটি কার্গো জাহাজকে অন্তত এক সপ্তাহ আটকে থাকতে হয়। এই সুযোগে স্থানীয় প্রভাশালী জনপ্রতিনিধি’র ছত্রছায়ায় একটি গ্রুপ ট্রলার নিয়ে গিয়ে আটকে থাকা জাহাজে বিভিন্ন অংকের চাঁদা দাবি করে। এ ক্ষেত্রে তারা বিআইডব্লিউটিএ’র চ্যানেল চার্জের নামের রশিদ প্রদান করে থাকে।
গত রোববার (১৮ ডিসেম্বর) অতিরিক্ত টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় চাঁদপুর ফরিদগঞ্জ কার্গো নামের মাল বোঝাই একটি জাহাজের চালক মো. ইরশাদ আলীকে মারপিট করে নদীতে ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটে। পরে তার সহকর্মীদের সহযোগিতায় তিনি আবার জাহাজে উঠতে সক্ষম হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুষ্ক মৌসুম শুরুর দিকে গত কয়েক বছর ধরে পদ্মা নদীর দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। যে কারণে প্রতি বছর এখানে আটকা পড়ে পন্যবাহি জাহাজ। দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় আটকে থাকা জাহাজ থেকে পন্য খালাসে প্রতি টনে দেড় থেকে দু’শ টাকা শ্রমিক খরচ দেয়া হয়। একেকটি জাহাজ থেকে অন্তত ২৫০ টন মালামাল খালাস করা হয়ে থাকে। জাহাজ মালিকদের কাছ থেকে চুক্তিতে পন্য খালাসের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দেয়ার পর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ লভ্যাংশ থাকে নদীতে শ্রমিক নিয়ন্ত্রকদের। এই লভ্যাংশ নিজেদের করতেও স্থানীয় একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। বিগত বছরে এই নিয়ন্ত্রণ নিয়েও নদীতে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম থেকে পাবনার নগরবাড়ি ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা কার্গো জাহাজ এমভি হোসনে আরা-৩ এর সুকানি তজিবর সরদার জানান, তাদের জাহাজটি কয়লা বোঝাই করে এসে তিনদিন আগে পদ্মা নদীর এ এলাকায় এসে আটকা পড়ে। এখানে অপেক্ষাকৃত ছোট ভলগ্রেড জাহাজে আংশিক মাল খালাস করে তাদের জাহাজের ড্রাপট কমিয়ে গন্তব্যে যাবে।
এমভি স্বপ্নতরী-২ কার্গো জাহাজের মাস্টার মো. মাহফুজুর রহমান জানান, বিগত বছরেও পদ্মা নদীর এই এলাকায় জাহাজ আটক পড়লে আংশিক মাল খালাস করে গন্তব্যে যেতাম। এর জন্য কাউকে কোন টাকা-পয়সা দিতে হত না। এ বছর চ্যানেল চার্জের স্লিপ দিয়ে ইচ্ছামত টাকা দাবি করা হচ্ছে। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাদেরকে সে টাকা দিতেও হচ্ছে।
এমভি সাহারা-২ কার্গো জাহাজের মাস্টার মো. ইব্রাহিম জানান, তারা আগেও এই নৌরুট দিয়ে চলাচল করেছে। ইতিপূর্বে এখানে তারা এ ধরনের চাঁদাবাজির শিকার হননি। কথিত চ্যানেল চার্জের নামে অতিরিক্ত টাকা তাদের কাছে দাবি করা হচ্ছে। চাহিদা মত টাকা না দিলে তাদেরকে মারধরসহ নানা ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।
নগরবাড়ি নামের ভলগ্রেড জাহাজের চালক ওমর ফারুক জানান, দৌলতদিয়ায় নতুন একটি গ্রুপ চলাচলকারী নৌযান থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য নদীতে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। তাদের কথা মত টাকা না দিলে তারা মারধর করে। তাদের ভয়ে নৌযান শ্রমিকরা সর্বক্ষন উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে।
দৌলতদিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জেএম সিরাজুল কবির বলেন, পদ্মা-যমুনা নদী এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় তারা সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করছেন। তবে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক ইজারা প্রদান করায় চ্যালেন চার্জের নামে চাঁদাবাজির সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। আবার ইজারাদার ইজারা নিয়ে তিনি সাব ইজারাদার নিয়োগ করেছেন। যেটা সম্পূর্ন অবৈধ। সাব ইজারাদার ইচ্ছামত টাকা আদায় করছে। তবে কাউকে শারীরিক নির্যাতন বা ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিআইডব্লিউটিএ’র আরিচা অঞ্চলের বন্দর কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন ফোনে জানান, নৌপথ সচল রাখতে ব্যায় নির্বাহের জন্য চ্যানেল চার্জ গ্রহনের ইজারা প্রদান করা হয়েছে। তার একটা নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। জাহাজে মালের টন প্রতি চার্জ নির্ধারণ করা। এর অতিরিক্ত টাকা আদায় অথবা জুলুম নির্যাতন করা হলে ইজারা বাতিলসহ ইজারাদারকে কালো তালিকা ভূক্ত করা হবে। ভূক্তভোগীরা সে বিষয়ে তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে ইজারাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এম/এস